বাংলাদেশ : আত্মপরিচয় ও শ্রেণিসংঘাত

Bangladesh Bangladesh

Bangladesh Bangladesh

When the sun sinks in the west

Die million people of the Bangladesh

The story of Bangladesh 

Is an ancient one

Again made fresh

Joan Baez.

১৯৭১-এ যখন তাজা রক্তে স্নাত নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছে, তখনই কি তার রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে বারবার রক্তপাতে নতুন নতুন করে জেগে ওঠবার ভবিষ্যটি লিপিবদ্ধ ছিল? অর্ধশতক পার করে এই জিজ্ঞাসা শুধু বাংলাদেশ নয়, এই উপমহাদেশের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্রের জন্য এই নবীন দেশটি এ পর্যন্ত অনেক রক্ত ঢেলেছে, বৃহত্তর জনসমাজের সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধান তাতে হয়নি। নবগঠিত রাষ্ট্রের দুর্বলতার ছিদ্রপথ দিয়ে অবধারিত ভাবে প্রবেশ-করা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্রতিবেশী ও বৃহৎ শক্তিগুলির ভূ-রাজনৈতিক-স্বার্থ-পরিপূরণের চাপ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলিতে বিচিত্র মাত্রা যোগ করেছে। ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, জাতীয়তা – ভাষা অস্মিতার আবেগকে ছাপিয়ে গিয়ে বহুস্তরান্বিত জটিলতার ক্রমবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। এযাবৎ বাংলাদেশে পাঁচটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে, বোঝা যায় যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা ও ভঙ্গুরতার চাপ সে দেশের জনসাধারণ রাষ্ট্রের জন্ম থেকে সহ্য করে আসছেন। বারবার প্রতিস্পর্ধায় ফেটে পড়তে হচ্ছে তাঁদের। গত জুন, ২০২৪ থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল। গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষায় বহু মানুষের রক্তপাত ও শাহাদাত বরণের যন্ত্রণাময় বিস্ফোরণে ঝড়ের মুখে কুটোর মত উড়ে গেছে ১৫ বছর ধরে স্বৈরতন্ত্র অনুশীলন করে চলা শেখ হাসিনা ও তার সরকার। এই পর্বের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুধু কোটা সংস্কারের মধ্যে আটকে রইল না, ছড়িয়ে পড়ল সমাজের নানা স্তরে। বিচিত্র বিপরীত মুখী শক্তি সমাবেশ ঘটল এবং সরকার পতনের দিকে এগিয়ে গেল। এই শক্তিগুলির নিজেদের মধ্যেকার সংঘাতে অস্থির বাংলাদেশে  বর্তমানে সাধারণ মানুষ আইনশৃঙ্খলা, মূল্যবৃদ্ধি ও সাম্প্রদায়িকতার মতো সমস্যাগুলির সাথে যুঝে চলেছেন, এতে নানারকম ঘৃতাহুতি দিয়ে চলেছে ভারত সহ অন্যান্য বহি:রাষ্ট্র ––এই অবস্থাটিকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সরকার বদলের মতো নেহাৎই এক রুটিন কার্যক্রমের জন্য বাংলাদেশের জনগণকে বারবারই আন্দোলন-অভ্যুত্থানের পথ নিতে হয়েছে। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের নির্বাচন ব্যবস্থা (তার সকল সংকীর্ণতা ও ত্রুটিবিচ্যুতি সহ) বারবার স্বৈরতন্ত্রের হাতে খারিজ হয়ে গেছে। প্রশাসনিক রাজনীতিতে সমরনায়কদের প্রবল প্রতাপ, ক্ষমতায় বারংবার উত্থান, অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়গুলিতে বারবার সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর উদগ্র হয়ে ওঠা, যদিও সমাজ মানসকে পুরোপুরি দখল করে নিতে পারে না, কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির গঠন যে কোনদিন ই সম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি তা প্রকট হয়ে ওঠে। আর মানুষও তাই বারবার পথে নামেন। এর উৎসমুখ খুঁজতে গেলে দেশটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পরিক্রমার প্রয়োজন থেকে যায়। একটি ঔপনিবেশিক ভূখন্ডের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্মকাহিনীর প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিক ভাবেই রয়ে গিয়েছে উপনিবেশজাত সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক সমস্যাবলী।

ভারত বিভাজন প্রসঙ্গ আলোচনার সূত্রে হিন্দুমুসলমান দ্বন্দ্ব ও দ্বিজাতিতত্ত্বের অবতারণা জনপ্রিয় বিতর্কের উপরিতলে ভেসে থেকেছে। উপনিবেশপূর্ব সমাজে ক্ষমতাসীন হিন্দু উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ্যবাদী গোষ্ঠী (যার আধিপত্য দীর্ঘ মুঘলশাসনে অটুট থেকেছে, বৃদ্ধি ও পেয়েছে অনেক ক্ষেত্রে)স্বাভাবিক ভাবেই ঔপনিবেশিক কাঠামোতেও শাসকের সঙ্গে অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক গাঁটছড়া বেঁধে সুবিধাজনক অবস্থানটি দখলে রেখেছিল। আর খেটে খাওয়া নিম্নবর্গ সমাজে বিশেষত বাংলায় ছিলেন নানা কারণে (অন্যতম কারণ বর্ণব্যবস্থার পীড়ন) ধর্মান্তরিত বিপুল সংখ্যক মুসলমান কৃষিজীবি। আধিপত্যের এই থাকবন্দীতে মুসলমান মেহনতী জনতার অবস্থান যে অর্থনৈতিক ও অতিরিক্ত-অর্থনৈতিক(extra economic coercion) চাপের নিম্নতম তলে ছিল তা বলাই বাহুল্য। দীর্ঘ কাল ধরে মুসলমান শাসনে থাকা এই ভারত-ভূখন্ডে মুসলিম সামন্ত অভিজাত, খানদানি শ্রেণিরও উপস্থিতি ছিল। পাশাপাশি ভারতীয় জাতব্যবস্থার প্রভাব মুসলমান সমাজেও পড়েছিল। ১৮৭১ এর জনগণনা থেকেই পরিস্কার হয়ে যায় ভারতে মুসলমান সংখ্যা কত এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের নিরিখে তাঁদের অবস্থানটা কী। পরবর্তীতে বিভিন্ন জনগণনার মধ্য দিয়ে বৃটিশ শাসক, শ্রেণী অবস্থানকে অস্পষ্ট করে দিয়ে গোটা মুসলমান সমাজকে তাঁদের ধর্মপরিচয়ে নির্মাণ করার কাজটি নিজস্বার্থে সম্পন্ন করে। অপরায়নের সামাজিক মাত্রা রাজনৈতিক মাত্রা পেতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়া শুরুর জন্য ১৮৫৭-র বিদ্রোহ ছিল শাসকের কাছে ট্রিগার পয়েন্ট। ১৯০১-এ রিজলির নেতৃত্বে হওয়া জনগণনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাউথ এশিয়ান স্টাডির অধ্যাপক নিকোলাস ডার্ক বলছেন “Risley’s anthropology worked not so much to retard Nationalism as to render it communal.In so doing it also left a bloody legacy for the south Asia that continues to exact a mounting toll.”

ধর্মপরিচয়ের লড়াইয়ে বলা বাহুল্য, তার দ্বিমুখী ধারের লাভটুকু ঔপনিবেশিক সরকার ঘরে তুলেছিল। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ তার গরল পান করতে বাধ্য হয়েছেন। মুসলিম লীগ ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিল সমগ্র মুসলমান সমাজের প্রতিনিধি। আর কৃষকপ্রজা পার্টির মতো দল বাংলায় তার প্রবল জনভিত্তি হারিয়েছিল। কংগ্রেসের মতোই মুসলিম লীগের নেতৃত্বও ছিল শিক্ষিত উচ্চবর্গীয়দের হাতে। উপনিবেশের প্রাথমিক বিজয়পর্বে যে ঔপনিবেশিক শিক্ষাসংস্কৃতির দিক থেকে মুখ ফিরিয়েছিল বিত্তবান মুসলমান সমাজ, ইতিহাসের করুণ পরিহাস, রাজনৈতিক ভাবে হিন্দু আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়তে সেই ঔপনিবেশিক শক্তির উপরেই নির্ভর করেছিল মুসলিম লীগ। বাংলার প্রান্তিক দলিত সমাজ হয়ে উঠতে পারত অন্ত্যজ মুসলমানের স্বাভাবিক রাজনৈতিক মিত্র, বিপরীত পরিণতি লাভ করল ধর্মীয় সংঘর্ষের বিপুল রক্তপাতে। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ে(১৯৪৬) যেমন আক্রান্ত ও নিহত হয়েছিলেন অগণিত দরিদ্র শ্রমজীবী মুসলমান তেমনি ওই বছরেই নোয়াখালির দাঙ্গায় আক্রান্ত হয়েছিলেন হিন্দু জমিদার ও বিত্তবানদের সাথে সাথে সাধারণ কৃষিজীবী প্রান্তিক দলিত হিন্দু। ১৪-ই অক্টোবর-এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চাঁদপুরের তৎকালীন এমএলএ যোগেন দাস যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলকে চিঠি ও লেখেন। প্রান্তিক দলিত সাধারণ ও সাধারণ মুসলমানের ঐক্যের পক্ষে যোগেন্দ্রনাথ উচ্চস্বরে সওয়াল করেছিলেন, মুসলিম লীগের উপর ভরসা করায় তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পরিণতি কী হয়েছিল সে কাহিনী অনেকেরই জানা। অন্য দিকে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা নিম্নবর্গীয় হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের পক্ষে-কথা-বলা এই মানুষটিকে ১৯৪৬-এর নির্বাচনে হারানোর জন্য কী ধরনের সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা তৈরি করেছিল সে গল্প ও ইতিহাসের ফাঁকে ফোকরে ইতিউতি জেগে আছে। বাংলায় জাতবৈষম্যের প্রশ্নগুলো ধীরে ধীরে প্রশ্ন-তোলা মানুষটির মতোই রাজনৈতিক পরিসরে গুরুত্ব হারায়। যাই হোক, এবার এইসব ধর্মীয়-রাজনীতির পিছনে সংগ্রামের যে মূল চালিকাশক্তি তার দিকে চোখ ফেরানো যাক। ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে উপমহাদেশের দেশীয় শাসক শ্রেণির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে ভূখন্ডের অর্থনৈতিক চালচিত্রটি কেমন ছিল,তার নিরিখে শ্রেণি দ্বন্দ্বের চেহারাটাই বা কেমন ছিল? কোন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ধর্মীয় পরিচিতির প্রশ্নটিকে ক্ষমতা হস্তান্তরকালে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে?

মনে রাখতে হবে এই সাম্প্রদায়িক আবহেই ঘটেছিল ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার দাবিতে তেভাগা আন্দোলন। ৪৬-এর শেষদিকে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে বাংলায় হিন্দু-মুসলমান কৃষকরা একসাথে লড়েছিলেন আর লড়েছিলেন উত্তর ময়মনসিংহে হাজংরা। একদিকে চরম পুলিশি অত্যাচার অন্যদিকে ৪৭-এর মার্চ থেকে বাংলাভাগের জন্য হিন্দুমহাসভার চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক প্রচারে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় তেভাগার এই লড়াই জোর হারায়। একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, যে-মুসলিম লীগ বাংলায় কোনদিন জনপ্রিয় ছিল না তা ক্রমশ শক্তি অর্জন করে মুসলিম সমাজের প্রধান মুখ হয়ে দাঁড়ায় ৪০ এর লাহোর প্রস্তাবের পর। এর অর্থ এই নয়, যে মুসলমান কৃষিজীবি শ্রেণি পৃথক রাষ্ট্রের দাবিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন তাঁরা খুব ধর্মান্ধ ছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন হিন্দু জমিদার অধ্যুষিত সামন্ততন্ত্রের নিগড় ভেঙে তাঁদের মুক্তি দিতে তাদের জন্য নির্দিষ্ট একটি নতুন রাষ্ট্রই পারবে। ধর্মীয় আধারের অন্দরে এ ছিল শ্রেনিরই লড়াই। ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মহা দুর্ভিক্ষে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পূর্ববাংলার গ্রামগুলি। সেই মহামারী ও মন্বন্তরের অকল্পনীয় দুর্দিনে পূর্ববাংলার অধিকাংশ হিন্দু জমিদারদের ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক। খাদ্য মজুত করে যথাসাধ্য উঁচু মূল্যে বিক্রি, ওই দুঃসময়েও জমির উঁচু রেন্ট নেওয়া, গ্রামীণ বাজার নিয়ন্ত্রণ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা এরকম হরেক দুষ্কর্ম মন্বন্তরের আকালে স্বাভাবিকতায় পরিণত করেছিল তারা। জমিদার মুসলমান হলেও তার ব্যত্যয় ছিল না। কিন্তু পূর্ববঙ্গের জমিদার শ্রেণি ছিল মূলত হিন্দু। এছাড়াও সরকারি আধিকারিক থেকে সব ধরণের উচ্চবৃত্তি ছিল হিন্দুদের দখলে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এইসবই আসলে নাম নিল ধর্মীয় পরিচিতির।

ইতিহাসের অভিনব কিছু মোচড় থাকে। ১৯০৫-এ যখন বাংলাকে প্রশাসনিক ভাবে ভাগ করা হয়, তাতে বৃটিশের খুব সদুদ্দেশ্য ছিল এমনটা নয়। কিন্তু তাকে ঘিরে হিন্দু বিত্তবান উচ্চবর্ণের পক্ষ থেকে যে প্রতিক্রিয়া এবং বঙ্গবিচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন ঘটেছিল তার আবেগপ্রসূত দিকটির থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল পূর্ববঙ্গে বহাল-থাকা তাদের বিরাট ভূসম্পত্তি ও সামাজিক আধিপত্য। তাই প্রথম দিকে হিন্দু মুসলমান ঐক্যের কথা বলা হলেও ধীরে ধীরে তা হিন্দু পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলনের দিকে বাঁক নেয়। জাতীয়তাবাদ নির্মাণে তারা বেছে নেন সেইসব বীরদের যারা মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। এইসব রাজনৈতিক দ্বন্দ্বগুলিকে তারা মুসলমান শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিদ্রোহ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম উদবোধক, পরে বীতশ্রদ্ধ রবীন্দ্রনাথ তার লোকহিত প্রবন্ধে বলেছিলেন “নিতান্ত সাধারণ সামাজিকতার প্রশ্নে যাহাকে আমরা ভাই বলিয়া, আপন বলিয়া মানিতে পারি না, দায়ে পড়িয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ভাই বলিয়া যথোচিত সতর্কতার সঙ্গে তাহার বুকে পড়িবার নাট্যভঙ্গি করিলে তাহা কখনোই সফল হইতে পারে না।” আন্দোলনের হিন্দু নেতারা তাই করেছিলেন, এবং মুসলমানদের সাড়া পাননি। বয়কটের নামে গরীব মুসলমানের উপর অত্যাচারের কথা ঘরে বাইরে উপন্যাসে সযত্নে ধরে রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রথম বাংলাভাগের অর্ধদশক অতিক্রান্ত হবার আগেই হিন্দু উচ্চবর্ণ নেতৃত্বের ঠিক বিপরীত আচরণ দেখা যায়। ৪৭-এ ক্ষমতা হস্তান্তরকালে, স্বতন্ত্র অবিভক্ত বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্ন উঠলে তাঁরা বাংলাভাগের পক্ষে চলে যান–ওই এক-ই কারণে–যুক্তবাংলায় সংখ্যালঘু হয়ে প’ড়ে আধিপত্য হারানোর আশংকায়। তাছাড়াও কলকাতার অবাঙালি পুঁজিপতিদের সাথে হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের জোট কলকাতা হাতছাড়া করার বিপক্ষে ক্রিয়াশীল ছিল।

অসংখ্য ভাগ্যহত মানুষের বুকের উপর দিয়ে র‍্যাডক্লিফ লাইন চলে যায়। দাঙ্গা, রক্তস্রোত, ধর্ষণ ও ভিটে হারানোর হাহাকার শ্রেণি-ভূমিকা গুলির তুলনায় ধর্ম পরিচয়ের দ্বন্দ্ব ও তার বীভৎসাকেই জাগরূক করে রাখে।

ভারতের বিকাশমান বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে শিল্প-বাণিজ্যে মুসলমানদের অংশগ্রহণ ছিল হিন্দুদের তুলনায় অনুপাতে কম। তা সত্ত্বেও পশ্চিম ভারতে বস্ত্রশিল্পে প্রতিযোগিতা ছিল। ১৮২১-এর জনগণনা তথ্য বলছে, বাংলা এবং পাঞ্জাবের মতো মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে মুসলমানরা গ্রামীণ কৃষিতে যুক্ত থাকলেও, (তবে পাঞ্জাবে ছিল বৃহৎ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজও ),তুলনায় সংখ্যালঘু অঞ্চলে, বোম্বাই আমেদাবাদের মত বিভিন্ন আরবান পকেটে মুসলমান পুঁজিপতি দের বিকাশ ঘটেছিল। আমরা এখন জানি তৎকালীন ভারতীয় পুঁজিপতিরা ভারত ভাগের পক্ষে নিরন্তর সওয়াল করে গেছে। দু-তরফেই। পুঁজির দ্বন্দ্ব অবশ্যই দ্বিজাতিতত্ত্বকে শক্তিশালী করেছে। এতদসত্ত্বেও পাকিস্তানের জন্মপরিচয়ে ধর্মীয় অস্মিতার প্রশ্নই প্রধান হয়ে রইল। অস্মিতার প্রশ্ন আবার কয়েকবছরের মধ্যেই নতুন রূপ নেবে ভাষাকে কেন্দ্র করে, ৭১ এ তার চূড়ান্ত পর্বটি ইতিহাস রচনা করবে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের কয়েক বছরের(১৯৪৮-এ উর্দুকে একমাত্র সরকারি ভাষা ঘোষণা করা হয়) মধ্যেই উর্দুর সাথে সরকারী ভাষা হিসাবে বাংলাভাষার মর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল হয়ে ওঠে। ১৯৫২, ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের রক্তে ভেসে যায় ঢাকার রাজপথ। আওয়ামী মুসলিম লীগ(পরে যার নাম হয় আওয়ামী লিগ–এই উত্তরণটিও লক্ষ্যণীয়)-এর নেতৃত্বে চলতে থাকে নাগরিক আন্দোলন। ১৯৫৬-তে বাংলাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরেও পশ্চিম পূর্বের সংঘাত থামেনি। ভাষার প্রশ্ন শুধু আবেগের নয়, শিক্ষিত শ্রেণির জীবন-জীবিকার প্রশ্ন তাতে জড়িয়ে থাকে। প্রশ্নটি অর্থনৈতিক। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের আপামর খেটে খাওয়া মানুষের আর্থসামাজিক সমস্যার সমাধান এতে হয়নি। শ্রেণি সংঘাত গুলি চলতে থাকে।

আমরা আগেই ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে শ্রেণিবিন্যাসগুলি  লক্ষ্য করেছি। বাংলার মুসলমানরা ছিলেন মূলত কৃষিজীবী, অন্যদিকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অথবা খানদানি মুসলমানদের বৃহৎ ভিত্তি ছিল পশ্চিমে। ক্ষমতার ভরকেন্দ্র পশ্চিমে হওয়াই স্বাভাবিক। এই বৈষম্যের এবং তার বিরুদ্ধে দাবিগুলির একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি পাকিস্তানের ইতিহাসবিদ তারিক আলির বয়ানে দেওয়া যায়।

“In 1947, the predominantly Hindu trader and landlord class of East Bengal migrated to West Bengal, which was and is a part of India, leaving their businesses and lands behind them. From the start this vacuum was filled by Bihari Muslim refugees from the United Provinces of India and non-Bengali businessmen from the Western portion of Pakistan. The economic exploitation of East Bengal, which began immediately after partition, led to an annual extraction of some 3 billion rupees (approximately $300 million) from the East by West Pakistani capital. The most important foreign-exchange earner was jute, a crop produced in East Pakistan that accounted for over 50 percent of exports. This money was spent on private consumption and capital investment in West Pakistan. The sums granted for development projects by the central government offer an interesting case study of discrimination. Between 1948 and 1951, $130 million were sanctioned for development. Of this, only 22 percent went to East Pakistan. From 1948 to 1969 the value of the resources transferred from the East amounted to $2.6 billion. The West Pakistan economy was heavily dependent on East Bengal, partly as a field for investment, but above all as a mine of subsidies and as a captive market. The Six Points demanded by the Awami League included both political and economic autonomy and directly threatened the immediate business interests of West Pakistani capitalists and their supporters embedded in the military and the civil service. The Six Points were:

1. A federal system of government, parliamentary in nature and based on adult franchise.

2. Federal government to deal only with defense and foreign affairs. All other subjects to be dealt with by the federating states.

3. Either two separate, but freely convertible, currencies for the two parts of the country or one currency for the whole country. In this case effective constitutional measures to be taken to prevent flight of capital from East to West Pakistan.

4. Power of taxation and revenue collection to be vested in the federating units and not at the center.

5. Separate accounts for foreign-exchange earnings of the two parts of the country under control of the respective governments.

6. The setting up of a militia or paramilitary force for East Pakistan.”

যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ৭১ কে ঘনিয়ে আনল তা ভাষার লড়াই হিসেবে জনপ্রিয় পরিসরে চিহ্নিত হয়ে থেকে গেল। ৪৭ থেকে ৭১ অস্মিতার লড়াইয়ের একটি বৃত্ত। ধর্মীয় আত্মপরিচয় থেকে ভাষাগত আত্মপরিচয়। আসলে এর মর্মস্থলে ছিল নিপীড়িত শ্রেণির সংগ্রাম ও দীর্ঘশ্বাস। শ্রেণি -রাজনৈতিক দিশার অভাবে এই পরিচয়ের লড়াইয়ের মধ্যে তা মাথা কুটে মরেছে। বুর্জোয়া নেতৃত্ব কখনোই লড়াইগুলিকে বিপদসীমা পার হতে দেয়নি।

সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে নাটকীয় ফল ফলল। পশ্চিমে হলো ভুট্টোর জয়জয়কার আর পূর্বে আওয়ামী লিগের দখলে এল ১৬২ আসনের ১৬০টি। ইয়াহিয়া খানের দৌত্যে ছ-দফা দাবি নিয়ে ভুট্টোর সাথে মুজিবের কথা হল এবং তা ব্যর্থ হল। পূর্ব পাকিস্তানের বামপন্থীরা বারবার মুজিবকে তৎক্ষনাৎ স্বাধীনতা ঘোষণা ক’রে লড়াই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দেন। প্রতিক্রিয়া আন্দাজ করে পশ্চিমও সৈন্যসমাবেশ করতে থাকে। লক্ষ্যণীয়ভাবে মুজিব এখানে একটি অদ্ভুত মধ্যপন্থা নেন। একদিকে দেন ননকোওপরেশনের ডাক অন্যদিকে অবিভক্ত পাকিস্তানের মধ্যেই সমাধান খোঁজার দরকষাকষি চালিয়ে যান। নন-কোঅপরেশন আন্দোলনে ছিল সাধারণের বিপুল সমর্থন, এর মধ্য দিয়ে পুর্ব পাকিস্তানের উপর মুজিব ও আওয়ামী লিগের দৃঢবদ্ধ নিয়ন্ত্রণ তৈরি হয়, জন্ম নেয় মুক্তিযুদ্ধ=আওয়ামী লিগের মিথ, বামপন্থী ও অন্যান্য সংগ্রামী শক্তিগুলির অবদানকে অস্বীকার ক’রে। যে মিথ, যে রাজনৈতিক ন্যারেটিভ, সম্ভবত ২০২৪-এর এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে চিরকালের জন্য বিলীন হয়ে গেল। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধতা করতে পারেন না। তাঁরা, তাঁদের মা বাপেরা রক্ত, প্রাণ, আশা, স্বপ্ন যোগ করেছিলেন তাতে। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত ‘আওয়ামী লিগের ন্যারেটিভ’ প্রত্যাখ্যান করেছেন, এটা বুঝে নিতে হবে। যাই হোক, ৩ রা মার্চ, ১৯৭১, পল্টন ময়দানে ‘স্বাধীনতার ইস্তেহার’’ পাঠ হয়। ৭ই মার্চ সুরাবর্দী উদ্যানে মুজিবের ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধের দেওয়াল লিখন হয়ে যায়,’’এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’’

এরপরের ইতিহাস সকলেরই কমবেশি জানা। অগণিত মানুষের রক্ত ও সংগ্রামে সার্বভৌম বাংলাদেশ উদিত হয়। ইন্দিরা সরকারের হস্তক্ষেপ নি:সন্দেহে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভকে নিশ্চিত করেছিল, সেইসঙ্গে এ-ও মনে রাখতে হবে যে পাকিস্তানি আর্মির তাড়নায় বিপুল বাস্তুচ্যুত মানুষের স্রোত আছড়ে পড়ছিল ভারতে। অর্থনৈতিক যে  সংকট তৈরি হয়েছিল তাতে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে ভারত রাষ্টের উপায় ছিল না। পাশাপাশি পাকিস্তানকে ১৩ দিনে পরাস্ত করে ইন্দিরা ‘’এশিয়ার মুক্তিসূর্য “ হয়ে ওঠেন, যিনি অবশ্য এর ৪ বছরের মধ্যেই এ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করবেন। পাকিস্তান বিভক্ত হলে তার শক্তি হ্রাস হবে ও নবগঠিত বাংলাদেশ ভারত রাষ্ট্রের প্রভাবাধীন থাকবে– এ সব কূটনৈতিক আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেখি, পাকিস্তানের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে ব্যাপক সমর্থন জুগিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পিছিয়ে  থাকা রাষ্ট্রগুলির মধ্যে প্রধানতম। পাকিস্তানের অন্য মিত্র চীন জাতিপুঞ্জে অংশীভূত হবার জন্য বাংলাদেশের আবেদনের বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছিল(১৯৭২)।

সমাজের উপরিতলে বিভিন্ন রাষ্ট্র পরিচালকদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে চোখ রাখা যাক শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ  মানুষের দিকে। গণতন্ত্র ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় যারা বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন কে সাকার করে তুলেছিলেন সর্বস্ব পণ ক’রে, যাঁরা ছিলেন এই সংগ্রামের মূল চালিকাশক্তি, তাঁরা কী পেলেন?

অস্থায়ী সরকার(১৯৭১-১৯৭২)–যার একটি নির্বাসিত কাল কেটেছে কলকাতা নগরীতে–এর মেয়াদ শেষ হলে ১৯৭২ নির্বাচনে আওয়ামী লিগ বিপুল জনাদেশ সহ সরকার গঠন করে। মুজিব বাংলাদেশের ২য় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। জাতির পিতা ও জাতীয় নায়ক হিসাবে ইতিহাসে নাম লেখা হল তাঁর। সংবিধান গৃহীত হল। মুক্তিযুদ্ধের জাগরূক ঢেউ গুলিতে ছিল গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের মতো আদর্শগুলি। সংবিধানের ঘোষনার মধ্যে তা প্রতিফলিত হল। কিন্তু ‘Rhetoric and reality’ নিয়ে লিখতে গিয়ে জি.কে. ম্যাথিউ তাঁর ‘Palace revolution continued’ প্রবন্ধে (১৯৭৬ এ EPW তে প্রকাশিত) সংগত কারণেই প্রশ্ন তুলেছেন সমাজতান্ত্রিক সমাজের দিকে যাত্রার সদিচ্ছা নিয়ে। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বিষয়টি তিনি পরিস্কার করেছিলেন : “the ideal of socialism cannot be translated into reality as easily or as quickly as the other three principles of state policy. In Bangladesh today it remains a vision and a dream.”

অসমাজতান্ত্রিক সমাজে কোন শ্রমিক অংশ গোটা অর্থনীতিতে তার সম্পূর্ণ প্রভাব সম্পর্কে অসচেতন থেকেও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে লড়াই করেন। স্বপ্নে সমাজতন্ত্র রেখে পরিকল্পনা কমিশন মেহনতী জনতার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন,

“The phenomenon where is trying to reap benefits guided by sectarian economic interests must be discouraged. There should be the will and the determination to transform a society with traditional values to a production oriented society where work,discipline and savings are the

basic tenets of economic activity.”

এই গাইডলাইনে পরিস্কার বোঝা যায় জনগণের দাবী আদায়ের অধিকারের বিরুদ্ধতা করা হচ্ছে, ব্যয় সংকোচের মধ্যে জনগণকে ঠেলে দিয়ে, ‘’ট্র‍্যাডিশনাল ভ্যালু’ মেনে বিদ্যমান সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসকে মেনে নিতে বলা হচ্ছে। আয়ের বৈষম্য তাই বাড়তেই থাকল। কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রের ১৯৬৯-৭৫ পর্যন্ত আয় ও অন্যান্য সূচকের দুটি প্রতিবেদন নীচে দেওয়া হল।

TABLE 1: INDEX OF PRICES AND WAGES

Annual AverageWholesale PriceOfficial Wage Level
AgricultureIndustryAgricultureIndustry
1969-70100100100100
1972-73187255180250
1973-74251320230275
1974-75444549290300

Source: “Economic Indicators of Bangladesh”, Statistics Division, Government of Bangladesh

ওপরের তথ্যগুলো থেকে পরিষ্কার, মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় শ্রমিক – কৃষকের আসল আয় স্বাধীনতার পর থেকে বছরে বছরে কমেছে।

TRENDS IN INDUSTRIAL PRODUCTION BETWEEN 1969-70 AND 1974-75

ProductUnit1969-701972-731973-741974-75Change overthe Period(percent)
JuteTons5,87,4874,46,3085,00,1674,42,000-24.76
Textile yarnLakh yards1,056818915913-13.54
Textile clothLakh square yards558590796845+51.43
SugarTons88,00019,29588,55698,500+11.93
FertilizersTons94,0002,12,0002,85,00072,900-22.45
PaperTons44,00021,74823,76857,700-27.85
NewsprintTons36,00027,35126,588
CementTons64,00032,00053,00089,900+40.47
CigarettesLakh sticks1,77,29064,4611,18,9501,04,436-41.09
ChemicalsTons12,93013,40014,50014,500-12.14
Tea1000 lbs.68,00054,00065,00065,000-4.41
Matches1000 boxes13,3935,9116,0895,627-57.99
Oil productsTons10,7059,562NANA-10.68
Steel IngotsTons54,13866,88172,600NA+34.10
Total: Production Index10065.3484.9280.75-19.25

Source: Government of Bangladesh Publications.

দু নম্বর টেবিলের তথ্যগুলি দেখলে বুঝতে অসুবিধা হবে না যে অর্থনীতির মূল ক্ষেত্রগুলিতে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে যার ফলে সামগ্রিকভাবে পণ্য উৎপাদন মার খেয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে এক  সামূহিক উৎপাদন সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল তা পরিষ্কার ।

সরকারি সূচকগুলি যা দেখাচ্ছে মেহনতী জনগণের অবস্থা বাস্তবে আরো খারাপ ছিল। নবগঠিত রাষ্ট্রের জনগণকে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় অনেক দু:খ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যাত্রার অভিমুখ ও ভিশন যদি সমাজকাঠামো পরিবর্তনের দিকে থাকে তবে সেই দু:খ-দুর্দশা তবু অর্থবহ হয়। বাংলাদেশের মেহনতী জনতার সে ভাগ্যোদয় হয়নি।

৭৩ থেকে সরকার স্বজনপোষণ, দুর্নীতি ও ক্ষমতালিপ্সার আখড়া হয়ে ওঠে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক দুর্দিন শ্রেণিসংঘাত ও বামপন্থার প্রভাব বৃদ্ধি অনিবার্য করে তোলে। আশংকিত মুজিব গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বিসর্জন দিয়ে, ২৮ শে ডিসেম্বর ১৯৭৪ , তিনমাসের জরুরি অবস্থা জারি ক’রে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির দমন এবং উগ্রজাতীয়তাবাদী ও মৌলবাদী শক্তিগুলির বিকশিত হবার ব্যবস্থা করে দেন। ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ ও তজ্জনিত মহামারীতে বহু মানুষের মৃত্যু, বিতরণ ব্যবস্থা ও মুজিব সরকারের অর্থনৈতিক নীতির সামূহিক ব্যর্থতা উন্মোচন করে দেয়। বাংলাদেশ স্বৈরতন্ত্রের দিকে হাঁটা শুরু করে।

জরুরি অবস্থার তিন মাস পূরণের আগেই ২৫ শে জানুয়ারি ১৯৭৫, সংবিধানে চতুর্থ সংশোধন ঘটিয়ে মুজিব একপার্টি সিস্টেম চালু করেন। আওয়ামী লিগ সহ সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিকে বাধ্য করা হয় নিজ পার্টির বিলুপ্তি ঘটিয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করতে যার পরিচালনার সব অধিকার মুজিবের হাতে আসে উক্ত সংশোধনী মারফৎ। সেই অধিকার বলে মুজিব তৈরি করেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লিগ,সংক্ষেপে বাকশাল। বাংলাদেশের একমাত্র জাতীয় পার্টি যার এক্সিকিউটিভ কমিটি সদস্য নিয়োগ থেকে শুরু করে মন্ত্রী নির্বাচন সবই সংশোধনী বলে বলীয়ান প্রেসিডেন্ট মুজিবের ইচ্ছানুসারে ঘটে। সরকারি চাকুরে থেকে শুরু করে সকল বৃত্তির মানুষ এমনকি ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের পর্যন্ত বাকশালে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তীব্র চাপের মুখে দাঁড়িয়েও বাকশালে যোগ দিতে অস্বীকার করেছিলেন। যোগ দিতে অস্বীকার করেছিল অধিকাংশ বামপন্থী কমিউনিস্ট দল। সমস্ত বিরুদ্ধ দলগুলিকে নিষিদ্ধ করা হয়। মুজিবের জাতীয় রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ, উল্লেখযোগ্য বিরোধী নেতৃত্বসহ অন্তত ৩০ হাজার রাজনৈতিক কর্মীর বিচারবহির্ভূত হত্যা ঘটায়। বহু মানুষ নিখোঁজ হয়ে যান। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র ছাড়া সব সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ করা হয়। প্রবল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে বাকস্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার সংকুচিত এবং বিচারবিভাগ নিস্ক্রিয় হয়ে যায়। সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যর্থতার বিপরীতে এই ছিল মুজিব-কথিত ও আওয়ামী লিগ দ্বারা সংগঠিত ‘’দ্বিতীয় বিপ্লব”। সংগত কারণেই জি.কে. ম্যাথিউ ‘’The palace revolution” শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন। কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লিগের আমলে শ্রমিক কৃষকের কী হাল হয়েছিল বোঝার জন্য উপরের দুটি প্রতিবেদনই যথেষ্ট।

বাকশাল বাংলাদেশের আগামী রাজনীতিতে কতকগুলি আপাত অনপনেয় দাগ রেখে যায়।

১) নবগঠিত রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে ওঠার শুরুতেই চূড়ান্ত আহত হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যহত হওয়ার মূল্য আজও বাংলাদেশবাসী দিয়ে চলেছেন।

২) মুক্তিযুদ্ধের সময় সামরিক শক্তি স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। তার অব্যবহিত পরেই বাকশালের প্রতিক্রিয়ায় সামরিক বাহিনীর সামাজিক প্রতাপ বৃদ্ধি পায়। যার মুজিব বিরোধী অংশটি ১৯৭৫ সালের অগস্টে পরিবারসহ মুজিবের ঘৃণ্য নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়। ক্যু-এর পরেই জারি হয় মার্শাল ল ও সেনা শাসন। ১৯৮৩-তে এরশাদের মার্শাল ল-এর শাসন শুরু হয় দ্বিতীয়বার। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সমরনায়কদের সক্রিয় উপস্থিতি স্বাভাবিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪-এর পর্বেও তা স্পষ্ট ভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। 

৩) মুক্তিযুদ্ধে শ্রেণি সংগ্রামের অংকুরিত চারাগাছটির বিকাশ ভাষা আন্দোলনের জাতীয়তাবাদী সীমায় রুদ্ধ হয়ে পড়ে।

৪) গণতান্ত্রিক পরিসর সংকুচিত হতে থাকে, স্বাভাবিকভাবেই সমাজ কাঠামোর মধ্যে ইতিমধ্যেই -ক্রিয়াশীল-থাকা সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী প্রবণতাগুলির ক্রমনিরসন সম্ভব হয় না। পরবর্তী সব শাসক নিজেদের স্বার্থমতো এই প্রবণতাকে নিজের কাজে লাগাতে থাকে।

স্বৈরতন্ত্রী ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার আওয়ামী সরকার বাংলাদেশে যথেচ্ছ লুঠতরাজের প্রশাসন চালিয়েছে। নিও লিবারেল জমানায় সাধারণ জনতার শোষণ-নিপীড়নের মাত্রাও আরও তীব্রতা পেয়েছে। সামাজিক সুরক্ষাবলয় ভেঙে পড়ছে বিশ্বজুড়ে। তার শিকার বাংলাদেশের মানুষও। এর সাথে হাসিনা সরকারের নির্বাচনের নামে প্রহসন, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার, স্বজনপোষণ, দুর্নীতি, পুলিশি অত্যাচার, গুমখুন, বিরোধীদের দেশছাড়া করা এবং সর্বোপরি অশেষ অর্থনৈতিক দুর্গতি মানুষকে পথে নামিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে শিক্ষার্থী আন্দোলনের ভূমিকা গৌরবময় ও গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৩ শাহবাগ আন্দোলন থেকে শুরু করে পরপর শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বিভিন্ন আন্দোলন ব্যপক জনসমর্থন লাভ করেছে। নির্দিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃত্ব না-থাকা আন্দোলনে নানা সামাজিক স্তরের মানুষের সমাবেশ ঘটায়, এক বিস্তৃত রাজনৈতিক পরিসর তৈরি করে যা সমাজের মাইক্রো স্তরে দীর্ঘ ধীর পরিবর্তন আনতে সক্ষম, ম্যাক্রো স্তরে কিছু সংস্কার। শ্রেণি সংঘাতকে সংগঠিত করে ব্যবস্থার আমূল বদলের দিকে যাত্রা করার শক্তি এই আন্দোলনগুলির থাকে না। এ শুধু বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য নয়। বৈশ্বিক বামপন্থী কমিউনিস্ট চর্চা ও প্রয়োগ তার শক্তি হারিয়েছে, সরকারি বামপন্থীরা সংস্কারেই আত্মতুষ্ট। সে অবশ্য অন্য আলোচনা। মূল কথা হলো বাংলাদেশের বর্তমান সমাজকাঠামো নতুন ব্যবস্থার প্রসব যন্ত্রণায় অস্থির কিন্তু ফেটে বেরনোর জন্য যে রাজনৈতিক দিশার প্রয়োজন তা অনুপস্থিত। ঐতিহাসিক ধারায় বাংলাদেশ রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভাবে যা অর্জন করেছে তা অস্মিতা ও জাতীয়তাবাদের বৃত্ত সম্পূর্ণীকরণ। তার ইতিবাচক দিক হলো মানুষের নিরন্তর অধিকার অর্জনের রক্তাক্ত লড়াই, আবেগ ও ত্যাগের মহত্বে তা তুলনারহিত। আর গণতন্ত্রের বিকৃত বিকাশের ফলে যে যে নেতির উদ্ভব হতে পারে তা পূর্বেই আলোচিত হয়েছে।

ভারতীয় নাগরিক হিসাবে,বিশেষত মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তার ইতিহাসে জারিত আমাদের জাতীয়তাবোধ,খুবই ধাক্কা খায় বাংলাদেশী নাগরিকের ভারত-বিরোধী সোচ্চার উচ্চারণে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ মানুষের পারস্পরিক বিষোদগার উভয় রাষ্ট্রনির্মিত জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের অংশ যা রাষ্ট্রকে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন যোগায়।কিন্তু বাংলাদেশের জন্মের সময় থেকে আজ অবধি ভারত -বাংলাদেশ সম্পর্ক কীভাবে বাংলাদেশের জনসাধারণের জীবনকে খুব মৌলিক স্তরে প্রভাবিত করেছে সেই প্রেক্ষিতটি না দেখলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের তথাকথিত ‘ভারত-বিদ্বেষ’ কে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

১৯৭১ এ নবগঠিত বাংলাদেশের সাথে ভারতের মধুচন্দ্রিমা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯ মার্চ ১৯৭২ এ স্বাক্ষরিত ভারত-বাংলাদেশ শান্তি ও মৈত্রীচুক্তির আর্টিকেলগুলি জুড়ে যে সমান পারস্পরিক মর্যাদা প্রদর্শনের বার্তা ছড়িয়ে ছিল, বাস্তবে বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত তা পালন করেনি। ফারাক্কা ব্যারেজ (২১শে এপ্রিল, ১৯৭৫ চালু হয়) চালু হওয়ার সময় বাংলাদেশের সাথে কোন আলাদা করে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি। বাংলাদেশের জন্মের আগেই ফারাক্কা জলচুক্তি একটি বিতর্কিত বিষয় ছিল। বাংলাদেশের সাথে একটি স্থায়ী চুক্তি ছাড়াই ব্যারেজ চালু হয়ে যায়, যা বাংলাদেশের জনগণ মুজিবের ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ বলেই মনে করেছিলেন। ফারাক্কা প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই ছিল কলকাতা বন্দর কে বাঁচানো, ফলে বাংলাদেশের কৃষি ও বাস্তুতন্ত্রে তা কী আঘাত আনতে পারে তা ভাবার জায়গাই ছিল না। মুজিবের মৃত্যুর পর ভারত ৭৭ সাল অবধি একপাক্ষিক সিদ্ধান্তে জলের সিংহভাগ টেনে নিতে থাকে।জলের সমান ভাগের দাবিতে শ্রদ্ধেয় নেতা মৌলানা ভাসানী ‘লং মার্চ টু ফারাক্কা ব্যারেজ ‘এর ডাক দেবেন জানিয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি দিয়েছিলেন

“….Personally intervene and work out a solution yourself, which could be acceptable to Bangladesh. If this was not done, I shall be compelled to follow the path of struggle I have learnt from your forefathers and Mahatma Gandhi…. “

এরপর গঙ্গা দিয়ে বহু জল বয়ে গেছে,নানা চুক্তি MOUস্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু ২০১৬, বানদুং : জার্নাল অব দি গ্লোবাল সাউথের রিপোর্ট বলছে –

‘… The water scarcity has brought much misery and hardship to the people of the affected south- western parts of Bangladesh that has resulted disruption of fishing and navigation, brought unwanted salt deposits into rich farming soil, adversely affected agricultural and industrial production, changed the hydraulic character of the rivers and brought about changes in the ecology of the Delta. Due to the Ganges diversion the minimum discharge of the river Padma at the point of Hardinge Bridge in Bangladesh fell far below. The groundwater level in the highly affected area went down particularly in the district of Rajshahi, Kustia, Khulna and Jessore. The south-west region had been facing the critical problem of salinity intrusion from the Bay of Bengal because of the drastic reduction of fresh water flows in the Gorai river which is the major distributary of the Ganges in this part of the country… ‘’

গত ৫৪ বছরে ভারত -বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিশ্চিতভাবে ভারতীয় আধিপত্য এবং প্রভাবের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে,এবং তা শোষণমূলক। বাংলাদেশ থেকে গেছে ভারতীয় লগ্নিক্ষেত্র ও অসম বাণিজ্যের শিকার হয়ে। মুক্তিযুদ্ধের পরে পরেই নবগঠিত বাংলাদেশের পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য যে চুক্তিগুলো হয়েছিল তখন তাতে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের দিক থেকে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল। কিন্তু তার পরবর্তীতেও এই দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে  বাংলাদেশে বাণিজ্যঘাটতি  কমার কোন লক্ষণ দেখা যায় নি। নব্বই দশকের নব্য উদারবাদের যুগে এসে ভারতীয় কোম্পানিগুলি বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে লগ্নি শুরু করে, বিশেষত টেক্সটাইল, ফার্মা এবং পরিকাঠামোয়। লগ্নিবৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ঘাটতিও বৃদ্ধি পেতে থাকে অথচ দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভারতের সর্ব বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার। ভারতীয় বাণিজ্য ও লগ্নির সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ধারাবাহিকভাবে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিগুলো বিশ্লেষকদের মতে বাংলাদেশের শ্রম এবং সম্পদ শোষণের শক্তিশালী হাতিয়ার। বাংলাদেশের পরিকাঠামো উন্নয়ন যেমন পাওয়ার প্ল্যান্ট, রেলওয়ে, সড়ক ইত্যাদিতে নিযুক্ত ভারতীয় প্রকল্পগুলি স্থানীয় সম্প্রদায় ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের দিকগুলির তোয়াক্কা করে নি। বাংলাদেশের সরকারগুলিও এসব ক্ষেত্রগুলোতে দেশের জনগণের ভালোমন্দ বিচার বিবেচনা করে নি। ভারতের লগ্নি করা টেক্সটাইল কারখানাগুলোতে কাজের পরিবেশ ও মজুরি নিয়ে যথেষ্ট অসন্তোষ রয়েছে। পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলির জন্য ভারতের কাছে বাংলাদেশের যে পরিমাণ ঋণ, তা বহু বিশ্লেষকের মতে বাংলাদেশের ঋণ সংকটকে ত্বরান্বিত করবে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আকার দিয়ে এসেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের ওপর। মোদ্দা কথা এই  দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক  ধারাবাহিকভাবে  বাংলাদেশের পরিবেশ, শ্রম ও বাণিজ্যের ওপর আঘাত করে এসেছে।

২৪-এর আন্দোলনকে বিশ্লেষণ করতে হবে উপরোক্ত সকল আলোচনার নিরিখে।সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে হাসিনার সমসময়ে ভারতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে একটা ফ্যাসিস্ট মৌলবাদী শক্তি, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ যার নিও-লিবারেল এজেন্ডা রূপায়ন করার প্রধান ছদ্মবেশ। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের থাবা আরও শক্ত হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিটি তুলনায়-কম-শক্তিধর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। মলদ্বীপে ভারতবিরোধী স্লোগান নির্বাচন জেতার প্রধান হাতিয়ার হয়েছে সম্প্রতি। শেখ হাসিনার ভারত রাষ্ট্রের প্রতি দাস্য মনোভাব-প্রসূত অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তাকে আরোই ঘৃণার্হ করে তুলেছিল। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তাঁদের মতো করে এইসবের বিরুদ্ধে বলেছেন। হাসিনা ভারতে আশ্রয় পাওয়ার পর এই ক্ষোভ বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। গণতান্ত্রিক শিক্ষা এবং পরিসর রহিত একটি সমাজে তার প্রকাশভঙ্গি যেমন হবার তাই হচ্ছে। উপদেষ্টা সরকারে একজনও শ্রমিক কৃষক প্রতিনিধি নেই। শ্রমিক আন্দোলনগুলি আওয়ামী লিগের আন্দোলন বলে চিহ্নিত হচ্ছে। সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, জনজাতির মানুষ ধারাবাহিকভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। এগুলির অনেকাংশই প্রথমদিকে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা এবং আওয়ামী-ঘনিষ্ঠতার শাস্তির মতো গুরুতর বিষয় ছিল। তাতে অবশ্য অনৌচিত্য বা উপদেষ্টা সরকারের ব্যর্থতা চাপা যায় না বা রাজনৈতিক দলগুলির দায়। কিন্তু বর্তমানেও এই সমস্যা সমাধানের রাস্তা পায়নি বা সমাধানে ইউনুস সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।তবে এই ঘটনাগুলির বিচ্ছিন্ন বিচারবিশ্লেষণ কোনো উপসংহারে পৌঁছবে না, একমাত্র বাংলাদেশের ইতিহাসের বিশ্লেষণই সমস্যার গলিঘুঁজিতে আলো ফেলে পথ দেখাতে পারে। এ-লেখাটি সেই দুর্গম পথে একটি অক্ষমজনোচিত ক্ষুদ্র প্রচেষ্টামাত্র। নয়ত ‘মৌলবাদী উত্থান’’,কালার্ড রেভুল্যুশন’বলে সংকীর্ণ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের সংগত ক্ষোভ, সংগ্রামকে অস্বীকার করে রক্ষণশীল শক্তির হাত শক্ত করাই যায়। বাম-ডান-মধ্য সবাই যে ভাবে বিজেপির উগ্রজাতীয়তাবাদি প্রকল্পের অংশ হয়ে যাচ্ছি–বুঝে না বুঝে–তাতে সত্যিই মনে হয় যে মাত্র-কাঁটাতারে-বিভাজিত এই বঙ্গভূমে আমরা কোন আদিকালের সহবাসিন্দা তা আমরা ভুলে গেছি। মিডিয়ায় ঘৃণার চাষ হল–উভয় দেশেই–আমরা তাতে অংশ নিলাম। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপি র আই টি সেল পরিকল্পিত ভাবে ছড়াল ফেক নিউজ ও ভিডিও, (বাংলাদেশের জামাত এ ব্যাপারে শিশু) আমরা উত্তেজিত হলাম, আছি এখনো, কার পতাকার কত ওজন তাই নিয়ে হিসাবে ব্যস্ত আছি, আশা রাখি শান্ত হব। শাসক সে সুযোগ না দিলেও হব।

ভেবে দেখব হাসিনার আমল কিছু সেকুলার ছিল না। সংখ্যালঘু তখনও নির্যাতিত হয়েছেন, যেমন আমাদের দেশে হন। এখন উপপ্লবের কালে অধিকতর সংগঠিত মৌলবাদী শক্তির কল্যাণে তার মাত্রার হেরফের ঘটছে। এখানে বিজেপি ক্ষমতায় আসবার পর চরম দক্ষিণপন্থী মৌলবাদী মেরুকরণে ক্রমাগত সংখ্যালঘু নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে সেটাও নিশ্চয়ই ভেবে দেখব কখনো। আমাদের সমাজ মানস তা মেনে নিচ্ছে কীভাবে? অদ্ভুত এই ধাঁধার উত্তর খুঁজব। খোঁজাটা প্রয়োজন, কারণ এখানে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দলটি আদর্শগত ভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনকে (বজরংদল, হিন্দু পরিষদের মত অজস্র পোষিত সংগঠনের মাধ্যমে) সমাজে অনুমোদন দেয়। গণতান্ত্রিক প্রকারে মোকাবিলা না করে জামাতকে ব্যান করে হাসিনা তার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছেন,অন্যদিকে জামাতের বদলে হেফাজতের মতো শক্তিকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন। এখন উপদেষ্টা সরকারের উপর জামাত চাপ সৃষ্টি করে, উল্টো  সামাজিক প্রতিরোধও হয় সেটা কোন পূর্বনির্ধারিত ধারণা দ্বারা চালিত না হয়ে খোলা চোখে দেখার প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শের মধ্যে সংখ্যালঘু নির্যাতন ন্যায্যতা পায়নি এখনো পর্যন্ত। এসব নিশ্চয়ই ভেবে দেখব আগামীতে। কেন হাসিনা ভারতেই আশ্রয় পেলেন, বাংলাদেশে জয় শ্রীরাম বলেন কোন হিন্দুরা, এইসব প্রশ্নগুলোও ২০২৬ এর আগে ভেবে দেখব নিশ্চিত। হিসেব করে নেব কে কত বড় জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক।

রাষ্ট্রের বিবর্তন প্রক্রিয়া ধীর। বিশেষত সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা জনগণের শোষণমুক্তির পথে একটি ধাপ মাত্র। বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের সেই পথে যাত্রা জারি থাকবে, সে শক্তির প্রমাণ তাঁরা বারবার দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে যে আন্দোলন ঘটল, তাতে মেহনতী জনতার সমর্থন থাকলেও নেতৃত্ব ছিল না। উপদেষ্টা কমিটিতেও তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই। ক্ষুদ্রঋণ ব্যবসায়ী মহম্মদ ইউনুস স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের সমস্যা সমাধানের উপযুক্ত ব্যক্তি নন। নিও লিবারেল পলিসিগুলির একনিষ্ঠ সমর্থক তিনি। তাছাড়াও উগ্র শক্তিগুলির কাছে বারবার নত হতে ও দেখা যাচ্ছে তাকে। অন্যায্য গ্রেপ্তারি, শ্রেণি আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা, আগামী নির্বাচন ঘোষণা সম্পর্কে নীরবতা বাংলাদেশের জনগণের জন্য অতীব দুর্ভাগ্যজনক। তবুও কিছু কথা মাথায় রাখা দরকার। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ এক নয়। বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত কোন ধর্মীয় মৌলবাদী সরকার গঠিত হয়নি ভারতের মতো। এতে সে দেশের সমাজমানস আন্দাজ করা যায়। সামগ্রিকভাবে বামপন্থার ক্ষয়িষ্ণুতা সত্ত্বেও এই পর্বে বামপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাঁরা যথাসাধ্য সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলা করছেন। ভারত রাষ্ট্র ভারতীয় জনগণের মতোই বাংলাদেশের জনগণেরও শত্রু, এই তাঁদের বিশ্লেষণ। জাতীয়তার চশমা খুললে এ কথার সারবত্তা বোঝা যাবে। দেশ ও রাষ্ট্র এক নয়। এক নয় দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ।

জুলাই আন্দোলনের চেতনা ইতিবাচক হয়ে উঠবে তখনই যখন বাংলাদেশের শ্রমজীবী শ্রেণী ও অন্যান্য নিপীড়িত অংশ সমাজের ধর্ম ও জাতিগত বিভাজন জয় করে সংগ্রামে নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করবেন।

মানুষই শেষ কথা বলবেন।

কৃতজ্ঞতা ঋণ:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

সুমিত সরকার 

তারিক আলি

জয়া চ্যাটার্জি 

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস 

জি.কে.ম্যাথিউ

দেবেশ রায়

অন্তর্জাল। 

(এই লেখাটি পূর্বে ওয়াচ টাওয়ার পত্রিকার ২০২৫ সালের বইমেলা সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। Alternative Viewpoint এ সামান্য পরিবর্ধিত করে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।)

Narendra Modi’s Election Setback Has Opened Up a New Horizon

Jammu Muslim Massacre – History Of An Overlooked Genocide

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *