শূন্য থেকে শুরু: চেনা প্রশ্নপত্রের বাইরে বেরিয়ে দুরূহ রাজনৈতিক পরীক্ষায় বামেরা আগ্রহী হবেন কি?

[প্রবন্ধটি ২০২১ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা,তবে এখনো তা সমান প্রাসঙ্গিক। সম্পাঃ]

২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল কার্যত সমস্ত রাজনৈতিক বিশ্লেষক তথা সেফোলজিস্টকে স্তম্ভিত করেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের এই অবিশ্বাস্য নির্বাচনী সাফল্যের পূর্বাভাস কারোর কাছেই ছিল না। বস্তুত, বিগত এক বছর ধরে খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে তুমুল প্রতিষ্ঠানবিরোধী আবেগ ধরা পড়ছিল সমস্ত রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক তথা গবেষকদের চোখে। তৃণমূলের অপশাসন ও স্বৈরাচারী প্রবণতা, কোভিড সঙ্কট মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা, পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্মম উক্তি ও সরকারী স্তরে উদাসীনতা, রেশন ব্যবস্থা, একশো দিনের কাজ, কেন্দ্রীয় আবাস যোজনার অর্থের বন্টন নিয়ে দুর্নীতি, পাথর খাদান, বালি খাদান, ইঁটভাটায় শাসক দলের সিন্ডিকেটরাজ, চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি, টেট ও স্কুল সার্ভিস কমিশনে ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতি, সরকারী কর্মচারীদের ক্ষোভ এবং সর্বোপরি আমফান ঝড়ের পরে রিক্ত নিঃস্ব মানুষের প্রাপ্য সরকারি ত্রিপল থেকে চাল পর্যন্ত তৃণমূল নেতাদের গুদামে ঢুকতে দেখা — সব মিলিয়ে নির্বাচনের এক বছর আগেও, মানুষের কাছে তৃণমূলের পক্ষে বলতে যাওয়া মানে ছিল কার্যত বিক্ষুব্ধ মানুষের ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালা।

যে এন আর সি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আসামের মানুষের জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছে, সেই সম্পর্কে একটা শব্দও তৃণমূল কংগ্রেস তাদের ইশতেহারে খরচ করেনি। বিজেপি এই আইনকে সমর্থন করে রাজ্যে তীব্র মেরুকরণের প্রচেষ্টা করে, অন্যদিকে সংযুক্ত মোর্চা স্পষ্টভাবে বলেছিল যে ক্ষমতায় এলে তারা কোনভাবেই রাজ্যে এন আর সি করতে দেবে না। গত কয়েক বছরে রোজগারের দাবিতে বামপন্থী ছাত্র-যুবরা লাগাতার পথে নেমেছেন। চাকরির দাবিতে বামফ্রন্টের ডাকে নবান্ন অভিযানের দিন পুলিশি সন্ত্রাসে মইদুল মিদ্যা নামক তরতাজা যুবকটি “লাশ” হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে সংযুক্ত মোর্চার ব্রিগেড সমাবেশে প্রান্তিক মানুষের ব্যাপক অংশগহণ বিধানসভা নির্বাচনে তৃতীয় শক্তির জোরদার উপস্থিতির কথা ঘোষণা করেছিল। অনেকেই আশাবাদী ছিলেন যে ঐক্যবদ্ধ বাম জোট হয়ত প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভোটের একটা বড় অংশ নিজেদের পক্ষে এনে প্রগতিশীল বিকল্পের সন্ধান দিতে পারবেন রাজ্যের মানুষকে। তৃণমূল-বিজেপি বাইনারির মধ্যে নির্বাচনী রাজনীতিকে আবদ্ধ রাখার এজেন্ডাকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন তাঁরা। দুর্ভাগ্যবশত, না সংসদীয় বামেরা, না বিপ্লবী বামপন্থীরা, কেউই এই শূন্যস্থানে নিজেদের প্রতিস্থাপন করতে পারলেন না।

একমাসব্যাপী রাজসূয় যজ্ঞ তথা গণতন্ত্রের প্রধান উৎসব শেষে বামপন্থীদের হাতে রইলো পেন্সিল। অন্তত আসন সংখ্যার দিকে তাকালে সেরকমটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। গত ৭৫ বছরে এই প্রথম বাম প্রতিনিধি ছাড়া আইনসভা গঠিত হবে বাংলায়। শুধু তাই নয়, নব্বই শতাংশের বেশী ভোট ভাগ হয়ে গেছে দক্ষিণপন্থী এবং উগ্র দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলোর মধ্যে। একথা সত্যি যে ফ্যাসিস্ট বিজেপি রাজ্যের ক্ষমতা দখল করতে না পারায় প্রগতিশীল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। কিন্তু একটা বিপজ্জনক রাজনৈতিক বাইনারির জন্ম দিল এবারের নির্বাচন — একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

নির্বাচন কমিশন-কেন্দ্রীয় বাহিনী-কর্পোরেট মিডিয়া — এই তিন স্তম্ভের ওপর ভর করে বাংলা দখলের পরিকল্পনা করেছিল বিজেপি, সঙ্গে ছিল তৃণমূলের দাগী দলবদলু এক ঝাঁক নেতা। প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হেলিকপ্টারে চড়ে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছেন টানা তিনমাস ধরে, এমন একটা সময়ে যখন কোভিড অতিমারীতে গোটা দেশ বিপর্যস্ত। অশ্লীলভাবে কাঁচা টাকা উড়েছে, সঙ্গে তীব্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের অপচেষ্টা। এই পাহাড়প্রমাণ চাপের মুখে দাঁড়িয়ে বাংলার মানুষ ঠান্ডা মাথায় অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে বিজেপিকে রুখে দিয়েছেন, যা অভিনন্দনযোগ্য।

তৃণমূলের এই “ল্যান্ডস্লাইড ভিকট্রি”-তে যারপরনাই আনন্দিত বামপন্থীদের একাংশ। নো ভোট টু বিজেপি নাম দিয়ে তাঁরা সোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার করেছিলেন, যদিও তার প্রভাব সীমিত ছিল শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভোটারদের মধ্যেই। সিপিআইএমএল (লিবারেশন)-এর বিহার নির্বাচনে অভূতপূর্ব সাফল্যের পরে (১৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১২টিতে জয়ী হয়েছেন তাঁরা) বাংলার মানুষ আশা করেছিলেন যে এবারের নির্বাচনে সার্বিক বাম ঐক্য গড়ে উঠবে, এবং বিজেপি আর পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মানচিত্রে তাদের প্রতিষ্ঠা দেওয়া তৃণমূল কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। কিন্তু লিবারেশন প্রধান শত্রু, অপ্রধান শত্রুর তত্ত্বে অনড় থাকায় সেই ঐক্য গড়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। দুর্ভাগ্যবশত, নকশালপন্থীদের এই অংশটি অন্যান্য বাম দলগুলোর ওপর আস্থা রাখতে পারলেন না। উল্টে ফ্যাসিবাদকে আটকানোর নামে কার্যত “ফ্যাসিস্ট এন্যাবলার” তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সুর নরম করলেন। তাদের বিভিন্ন ক্যাম্পেন এবং কথাবার্তায় সিপিএম তথা বামফ্রন্ট বিরোধিতার যে ঝাঁঝ দেখা গেছে, তার কণামাত্র শাসক তৃণমূলের জন্য বরাদ্দ হয়নি। রাজনৈতিক অপরিণামদর্শিতার এত বড় নিদর্শন বামপন্থী বিশ্লেষকদের ভবিষ্যৎ গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে। বিজেপিকে যেনতেন প্রকারেণ আটকানোর তাড়নায় তাঁরা এটা বুঝতে পারলেন না, যে দীর্ঘমেয়াদে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিকল্প তৃণমূলের নরম সাম্প্রদায়িকতা নয়। একমাত্র ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক-কৃষক এবং নিপীড়িত আত্মপরিচয়ের জোটই পারে ফ্যাসিবাদকে রুখতে। ইতিহাসবোধবিচ্যুত ভোটকেন্দ্রিক শহুরে বামেদের ডিজিটাল উত্থান এবারের নির্বাচনের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি হয়ে থাকবে।

মনে রাখা প্রয়োজন, বিহারের যে মহাগঠবন্ধন মডেলকে সামনে রেখে দীপঙ্করবাবুরা তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে সমঝোতায় আসতে চেয়েছিলেন, তা তৈরী হয়েছিল সে রাজ্যের শাসক জনতা দল (ইউ) এবং বিজেপির বিরুদ্ধে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস দীর্ঘ ১০ বছর শাসন ক্ষমতায় থাকায় তাদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া ছিল তীব্র। ২০১৮ সালে “বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত” করতে গিয়ে বাম-কংগ্রেস কর্মী সমর্থকদের ওপর তীব্র নির্যাতন নামিয়ে আনে তারা, একদিকে দলের মস্তান বাহিনী আর অন্যদিকে প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে। হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে ঘরছাড়া হতে হয়েছিল সেই সময়ে, মিথ্যা মামলায় সাধারণ মানুষকে জড়ানো জলভাত হয়ে গেছিল। “রাস্তায় দাঁড়ানো উন্নয়ন”-কে বাংলার মানুষ যে ভালভাবে নেননি, তার প্রমাণ ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল। বামপন্থীদের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে মানুষ প্রাণপণে রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় থাকার সুযোগে এবং মোদীর সুপারম্যান ইমেজকে (যার পুরোটাই পেটোয়া মিডিয়ার গড়ে তোলা) কাজে লাগিয়ে তীব্র তৃণমূলবিরোধী ভোটকে নিজেদের দিকে টেনে আনতে সক্ষম হয় বিজেপি। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ৪৪.৯১%, বামফ্রন্ট ২৫%, কংগ্রেস ১২.২৫% এবং বিজেপি মাত্র ১০.১৬% ভোট পেয়েছিল। তিন বছরের মধ্যে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এক ধাক্কায় ৩০% ভোট বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে বামেরা সাত শতাংশ আর কংগ্রেস ৫.৬৭% ভোট পেয়ে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। তৃণমূলের ভোটও কমে দাঁড়ায় ৪৩.৬৯%। সেইসময় একটি জনপ্রিয় ব্যাখ্যা ছিল যে “বামের ভোট রামে গেছে”। বলাই বাহুল্য, এটা অতি সরলীকরণ।

লগ্নিপুঁজির বিশ্বায়নের সঙ্গে তীব্র সংখ্যালঘু বিদ্বেষের একটা ধনাত্মক অনুবন্ধ রয়েছে। বাঙালি মুসলমানের প্রতি হিন্দুদের একাংশের মধ্যে ঘৃণা তৈরির ক্ষেত্রে বিজেপি তথা আরএসএসের কোলঘেঁষা সংবাদমাধ্যম সফলভাবে দেশভাগের বিকৃত ইতিহাসের সঙ্গে তথাকথিত মুসলিম তোষণের অভিযোগকে মিলিয়েছে। শরণার্থী এবং অনুপ্রবেশকারী — এই দুই শব্দবন্ধ চালু করার মাধ্যমে ধর্মের ভিত্তিতে উদ্বাস্তু মানুষের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়েছে তারা। এই যে তথাকথিত বাম ভোটার — এরাও এই সামাজিক বাস্তবতার বাইরে নয়। তাদের একটা বড় অংশ ২০১৯-এ বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু এবারের নির্বাচনে এই ভোটাররা বিজেপির দিক থেকে অনেকটাই মুখ ফিরিয়েছেন। কারণ রুটি রুজির প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন নীতি সরাসরি তাদের ভাতের থালায় টান মেরেছে। একইসঙ্গে দেশব্যাপী কৃষক আন্দোলনে শতাধিক মানুষের মৃত্যু সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকারের অমানবিক ও নিস্পৃহ নীতিসমূহ বিজেপির কর্পোরেটবান্ধব মুখটা চিনতে সাহায্য করেছে তাঁদের।

যদিও রাম-বামের এই প্রচার ছিল মূলত বিজেপির আই টি সেলের তৈরি, তা লুফে নেয় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রচার শাখাও। বামপন্থীরা বিজেপির মত সাম্প্রদায়িক দলকে সমর্থন করছে, এই ধারণা মানুষের মনে গেঁথে দেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হল বাংলার মুসলমান সমাজের সামনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মেসায়া রূপে প্রতিষ্ঠিত করা। এবং একইসঙ্গে বাংলায় তীব্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তৈরি করা। এই প্রচারের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি যদিও ছিল না। ২০১৬-র বিধানসভার নিরিখে লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের যে ১৮% ভোট কমেছিল, তার একটা অংশ স্বাভাবিক ভাবেই শাসনক্ষমতায় থাকার সুযোগে তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের দিকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। আর একটা অংশ তৃণমূল বিরোধিতার ক্ষেত্রে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া বামেদের উপর আস্থা রাখতে না পেরে বিজেপিকে ভোট দেয়। কিন্তু কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটারদের একাংশের ভোট না পেলে বিজেপির এই উল্কাসম বৃদ্ধি যে সম্ভব হত না, এই সহজ সত্যিটাকে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে চেপে যাওয়া হয়। ভোটের এই redistribution বা পুনর্বন্টনের ফলে বিজেপি রাজ্যের প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে উঠে আসে। যেহেতু বামপন্থীদের শক্তিহীন করাটাই বিগত ১৩ বছর ধরে গভীর সঙ্কটে আক্রান্ত গ্লোবাল ফিন্যান্স ক্যাপিটালের জন্য একান্ত সুবিধাজনক, ফলে “একুশে রাম, ছাব্বিশে বাম” — এই রাজনৈতিক ন্যারেটিভ সযত্নে নির্মাণ করা হয়।

একথা অনস্বীকার্য, নিজেদের পার্টি লাইনের বিরুদ্ধে গিয়ে এক শ্রেণীর সিপিআইএম নেতা তৃণমূলকে প্রধান শত্রু হিসাবে প্রোজেক্ট করার অতি উৎসাহে তাঁদের কর্মীদের বিপথে চালিত করেছেন। দক্ষিণপন্থার এই চূড়ান্ত উত্থান যে বিশ্বায়িত লগ্নিপুঁজির মুনাফা বৃদ্ধির স্বার্থে — এই বৃহত্তর রাজনৈতিক সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে শুধুমাত্র স্থানীয় ইস্যুর ওপর ফোকাস করা ছিল কার্যত রাজনৈতিক আত্মঘাতের সমান। এবং কিছু সিপিআইএম নেতা লাগাতার এই দুষ্কর্মটি করে গেছেন। ফলে বিভ্রান্ত হয়েছেন সাধারণ ভোটার। বিজেপির বিরুদ্ধে যে আদৌ তাঁরা শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম, এই বিশ্বাসটাই গড়ে ওঠেনি জনমানসে। ফলে নির্বাচনের ফল বেরনোর পর বামপন্থীরা কার্যত মুছে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের সংসদীয় রাজনীতির মানচিত্র থেকে। বস্তুত, নির্বাচনের পরে সংবাদমাধ্যমের সামনে সিপিআইএমের একাধিক নেতার দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন মুখ খোলা থেকে এটা প্রমাণিত, যে তাদের পার্টির মধ্যেকার আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র এবং শৃঙ্খলা, দুটোই সমান বিপন্ন।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। শুভেন্দু অধিকারী, যিনি বাংলার রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের এপিটোম হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁর জয়ে সিপিআইএমের এক তরুণ তুর্কি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন, পরে যদিও ভুল বুঝতে পেরে তিনি সেই পোস্ট মুছে দ্যান। তিনি নাহয় অনভিজ্ঞ, কিন্তু দীর্ঘ চার দশক কমিউনিস্ট রাজনীতির সাথে যুক্ত, বিধানসভায় বামফ্রন্টের প্রাক্তন দলনেতা, সুজন চক্রবর্তীও কার্যত সেই পথে হাঁটেন। গোটা নির্বাচনী মরসুমে সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব তৃণমূল কংগ্রেস প্রধানকে সমালোচনা করে যত বক্তব্য রেখেছেন, তার ভগ্নাংশও বরাদ্দ ছিল না নরেন্দ্র মোদীর জন্য। অথচ গত সাত বছরে মোদী-শাহের নেতৃত্বে সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বিজেপির হাতের পুতুল হয়ে গেছে। পার্টির কেন্দ্রীয় লাইনের উল্টো পথে হেঁটে কার্যত ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপির বিপদকে ছোট করে দেখেছেন সিপিআইএমের রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ। ফলে প্রকৃত বিরোধী শক্তি হিসাবে মানুষের চোখে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে তাঁরা চূড়ান্ত ব্যর্থ। লাগাতার নির্বাচনী বিপর্যয় তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

আরও একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। এবারে নির্বাচন চলাকালীন শীতলকুচিতে চারজন সংখ্যালঘু মানুষকে, দায়িত্ব নিয়ে বলছি, জামাকাপড় দেখে কেন্দ্রীয় বাহিনী খুন করল এবং ইলেকশন কমিশন অন্ধ-বধির হয়ে রইল। তখন সুজনবাবুরা রাষ্ট্রীয় খুনের প্রতিবাদে রাস্তায় নামেননি, ঘুরিয়ে উস্কানি তত্ত্ব দিয়ে সেই খুনকে ন্যায্যতা দিয়েছিলেন। এর উত্তর নির্বাচনের পরবর্তী দফাগুলোতে বাংলার সংখ্যালঘু মানুষ ব্যালটের মাধ্যমে দিয়েছেন, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত মালদা-মুর্শিদাবাদে বিজেপিকে আটকানোর জন্য বাম/কংগ্রেসের বদলে মুসলিম ভোটাররা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপরে আস্থা রেখেছেন। অথচ এই জেলাগুলোতেও যেখানে যেখানে হিন্দু ভোটাররা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে বিজেপি ভালো ফল করেছে, বেশ কিছু আসন জিতেছে তারা। নয়া উদারবাদী অর্থনীতির বিশ্বস্ত অনুচর কংগ্রেসের সাথে জোট করে কার্যত নিজেদের সংগঠন সেখানে জলাঞ্জলি দিয়েছে সিপিএম। এবং আরএসপি, ফরোয়ার্ড ব্লকের মত শরিক দলগুলোকে গিলে খাওয়ার যে অপচেষ্টা তাদের মজ্জাগত, তার মাশুল চোকাতে হচ্ছে তৃণমূল-বিজেপি বাইনারিতে কার্যত নিজেরা নিঃশেষিত হয়ে।

অথচ প্রথম চারটি পর্বে জোট যথেষ্ট পরিমাণে মুসলমান ভোট পেয়েছিল, তার সবথেকে বড় প্রমাণ দক্ষিণ ও উত্তর চব্বিশ পরগণায় আইএসএফের তুলনামূলক ভালো ফল। আসলে শ্রমজীবী মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতে সাধারণ মানুষের পালসটাই আর বঙ্গ সিপিএম নেতারা বুঝতে পারেন না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে যে নয়া উদারবাদী উন্নয়নের দর্শনকে আঁকড়ে ধরেছিল বামফ্রন্ট, তারই ফলশ্রুতি বৃহৎ বেসরকারি পুঁজিনির্ভর শিল্পায়নের মডেলের অন্ধ অনুসরণ। ভ্রান্ত শিল্পনীতি ও জমিনীতির ফলে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামকে কেন্দ্র করে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে তীব্র জনরোষ গড়ে ওঠে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের আমলে। একই সাথে সাচার কমিটির রিপোর্ট এই রাজ্যের সংখ্যালঘুদের আর্থসামাজিক দুরবস্থাকে স্পষ্ট করে দেয়। অবশ্য তৎকালীন বামসরকার সাচার কমিটির কিছু কিছু সুপারিশ কার্যকর করেছিল।এই ক্ষোভকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটান। কিন্তু আজও সেজ নীতি, টাটা-সালেমের হাত ধরে কাল্পনিক উন্নয়নের খোয়াব দেখছেন সিপিএম নেতৃত্ব। ফলে সুস্পষ্টভাবে নিজেদের ভুল স্বীকার করার লক্ষণটুকুও গত দশ বছরে দেখা যায়নি। এবারের নির্বাচনী প্রচার দেখেও মনে হয়েছে “কারখানা ওয়াহি বনায়েঙ্গে” নীতি থেকে তাঁরা সরে আসেননি। মেহনতি মানুষের বদলে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের পার্টি হয়ে ওঠার এই সাধনা বাংলার সিপিএমের শ্রেণী চরিত্রকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। এমনকি নতুন প্রজন্মের যে নেতৃত্ব উঠে এসেছে, তার বেশিরভাগই এলিট প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী। শ্রমিক বা কৃষক ফ্রন্টে কাজের কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই তাঁদের সংসদীয় রাজনীতির আবর্তে ছুঁড়ে দিলেন রাজ্য নেতৃত্ব। ফলে এই উজ্জ্বল ছেলেমেয়েদের মুখেও সেই একই চর্বিত চর্বন দেখলাম আমরা, নতুন যুগের কমিউনিস্ট রাজনীতির কোন ভাষ্য নির্মিত হল না।

তরুণ প্রার্থীদের নির্বাচনী সভায় মানুষের ঢল নামলেও তার প্রতিফলন ব্যালট বাক্সে ঘটেনি। এর কারণ ক্ষয়িষ্ণু সংগঠন এবং রাজনৈতিক ভাবনার ক্ষেত্রে মধ্যশ্রেণীর আধিপত্য। স্কুল সার্ভিস কমিশন বা অন্যান্য সরকারি চাকরিতে দুর্নীতি নিয়ে যত কথা ভোটের ময়দানে বামপন্থীরা খরচ করেছেন, তার সিকিভাগও কৃষি আইন, শ্রম কোড নিয়ে তাঁরা করেননি। লকডাউনে শ্রমজীবী ক্যান্টিন করার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে সামাজিক সুরক্ষার দাবীতে মানুষকে সংগঠিত করার কাজটা তাঁদের করার কথা ছিল। সেই দায়িত্ব পালনে তাঁরা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ। “দরকারে পাশে থাকা”-র সাথে “সরকারে আসা”-র সম্পর্ক যে নেই, এটা বোঝার বোধশক্তিটুকুও তাঁরা হারিয়েছেন। এন আর সি বিরোধিতার মত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে না নামার ফলে সংখ্যালঘুদের আস্থাও যে হারিয়েছেন তাঁরা, একথাও এবারের নির্বাচনের ফলে স্পষ্ট।

অথচ এই উগ্র ফ্যাসিবাদী আবহেও যে বামপন্থীরা জনতার দরবারে প্রাসঙ্গিক থাকতে পারেন, তার সবথেকে বড় প্রমাণ কেরালা। শবরিমালাকে কেন্দ্র করে বামপন্থীদের আসনচ্যুত করার মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয়েছিল, সঙ্গী গোদী মিডিয়া আর নয়া উদারবাদী প্রকল্পের স্যাঙাত কংগ্রেস। কিন্তু এত কিছুর পরেও সেখানে উপর্যুপরি দ্বিতীয়বার ঐতিহাসিক জয় বামপন্থীদের, আর বিজেপি তাদের সবেধন নীলমণি একমাত্র আসনটাও ধরে রাখতে পারল না। তামিলনাড়ুও চারজন বামপন্থী বিধায়ক পেলো এবারের নির্বাচনে, তুমুল সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মধ্যেও অসম পেল একজনকে। আর তেভাগা আন্দোলনের বাংলায় বামপন্থীরা আজ আইনসভায় শূন্য। কিন্তু তারপরেও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা থেকে যায়। নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, কমিউনিস্টদের আসল জায়গা রাস্তায়, কারখানার গেটে, কৃষক আন্দোলনের জমায়েতে, আর্ত মানুষের পাশে।

নয়া উদারবাদী অর্থনীতির বিপদ সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়নের অভাব বঙ্গ সিপিএমকে কংগ্রেসের সাথে আত্মঘাতী নির্বাচনী জোটের দিকে ঠেলে দিল। একটু খুঁটিয়ে লক্ষ করলে আমরা দেখতে পাব যে আজ বিজেপি যা যা বলছে এবং করছে, তার পুরোটার একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের হাত ধরে সেই ১৯৯১ সালে ভারতবর্ষে শুরু হয়েছিল নয়া উদারবাদী অর্থনীতির জয়যাত্রা, যার পোশাকি নাম উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ, বিশ্বায়ন। ব্যাঙ্ক-বীমা-সরকারি ক্ষেত্রে ব্যাপকহারে বিলগ্নিকরণ ও কর্মী ছাঁটাই, অনুপ্রবেশ ও সন্ত্রাসবাদের জুজু দেখিয়ে নাগরিকত্ব আইনে বদল আনা, কাশ্মীর প্রসঙ্গে নীতিপঙ্গুত্ব এবং কার্যত সেখানকার হিন্দু-মুসলমান সাধারণ মানুষের প্রতি রাষ্ট্রীয় বিশ্বাসঘাতকতা, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-ক্ষুধার মত মৌলিক বিষয়ে যথোপযুক্ত নজর না দিয়ে সামরিক খাতে কোটি কোটি ডলার খরচ, মন্দির-মসজিদের রাজনীতি, কৃষক-শ্রমিক বিরোধী বিভিন্ন আইন প্রণয়ন, আধার কার্ডের নামে নাগরিকদের ব্যক্তি পরিসরে রাষ্ট্রের নজরদারি — এর সবকিছুই কংগ্রেস আমলে হত, তবে বিশেষ ঢাকঢোল না পিটিয়ে। মনমোহিনী আর্থিক নীতি গ্রহণ করার পরে গত তিন দশকে ভারতবর্ষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বহুগুণ বেড়েছে। বছর খানেক আগেকার এক রিপোর্ট বলছে যে আমাদের দেশের সবচেয়ে ধনী এক শতাংশ নাগরিকের হাতে রয়েছে দেশের দরিদ্রতর ৭০ শতাংশের চেয়ে চার গুণ বেশি সম্পদ। সাম্প্রতিক কোভিড অতিমারী এবং তজ্জনিত লকডাউনের ফলে একদিকে শুধুমাত্র এপ্রিল থেকে আগস্ট — এই পাঁচ মাসে ১২ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়েছেন। এই একই সময়কালে দেশের একশোজন ধনকুবেরের ১৩ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ বেড়েছে!

শুধুমাত্র অতিমারীর দোহাই দিয়ে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির বৈষম্যমূলক প্রবণতাকে ঢাকা যাবে না। ভারতবর্ষের এই ভয়াবহ অসাম্য একটি বিশ্বব্যাপী প্রবণতার অংশ। এর শিকড় রয়েছে বুর্জোয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মূল দর্শনে। অমর্ত্য সেন থেকে টমাস পিকেটি — পৃথিবীর সব শীর্ষস্থানীয় উন্নয়নমূলক অর্থনীতির গবেষকের মতে অসাম্যে রাশ টানা সম্ভব। কিন্তু তার জন্য সবার আগে প্রয়োজন সঠিক সরকারি নীতি। দরকার সম্পদের সমবণ্টনের মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার দায়বদ্ধতা। প্রয়োজন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দ বহুগুণ বাড়িয়ে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। দেশের বিপুল জনসম্পদকে স্বনির্ভর করার মাধ্যমেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ী হওয়া সম্ভব।

প্রশ্ন হল, কংগ্রেস বা অন্য কোনো দক্ষিণপন্থী শক্তির হাত ধরে কি নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে ব্যারিকেড গড়ে তোলা আদৌ সম্ভব? এক কথায় এর উত্তর হল “না”। বিজেপির অর্থনৈতিক কর্মসূচিগুলোর প্রত্যেকটার সূচনা কংগ্রেসের হাতে। এবং আজ যে শিল্পগোষ্ঠীগুলো বিজেপির পৃষ্ঠপোষক, সেই একই গোষ্ঠীগুলো অতীতে কংগ্রেসকে সমর্থন করেছে। শ্রেণীপ্রভুদের কাছে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখার তাগিদেই কংগ্রেসের পক্ষে বিজেপি পরিচালিত ফ্যাসিবাদ রুখতে আগ্রহ থাকতে পারে না। কৃষক-শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী আইনগুলো বদল করা, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলোর বেসরকারিকরণ রুখে দেওয়া, সংখ্যালঘু ও দলিতদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কাশ্মীর বা দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলে সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসে লাগাম পরানো, আফস্পা, ইউএপিএ, টাডা প্রত্যাহার — এর কোনটাই তার শ্রেণীগত অবস্থানের কারণেই কংগ্রেসের পক্ষে করা সম্ভব নয়।

তাহলে গত প্রায় এক দশক ধরে কেন কংগ্রেস বৃহৎ পুঁজির সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত? এর উত্তর পেতে হলে আমাদের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির দিকে নজর ঘোরাতে হবে।

২০০৭-০৮ সালের বিশ্বব্যাপী মন্দার ফলে পুঁজিবাদের যে সঙ্কট তৈরি হল, তার থেকে মুক্তি পেতে পুঁজির নিজস্ব তাগিদেই উত্থান শুরু হল বিভিন্ন ফ্যাসিস্ট শক্তির — আমেরিকায় ট্রাম্প, ব্রাজিলে বোলসোনারো, তুরস্কে এরদোগান, ভারতবর্ষে মোদী। ওই সময় ওবামা বা মনমোহনের মত ধীর স্থির সংস্কারবাদীদের দিয়ে কাজ উদ্ধার হবে না, এটা বুঝে গিয়েছিল বিশ্বায়িত লগ্নিপুঁজির মাতব্বররা। ফলে মানুষের মস্তিষ্কের ভিতরে আক্রমণ শুরু হল, এই কাজে প্রধান সহায় ছিল কৃত্রিম মেধা। কেমব্রিজ এনালিটিকা কেলেঙ্কারি জন্ম দিল সমাজবিজ্ঞানের এক নতুন পরিভাষার — উত্তর সত্য। পকেটে থাকা মুঠোফোনে ভর করে বিকৃত তথ্য পৌঁছনো শুরু হল সমাজের সর্বস্তরে, বিশ্বব্যাপী ঘৃণা ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ সৃষ্টি হল। ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদ প্রথমে রাস্তার লড়াইতে জিতে পরবর্তীকালে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে শাসনক্ষমতা দখল করত। উত্তর সত্যের দুনিয়ায় তারা সরাসরি ভোটে জিতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করছে এবং লগ্নিপুঁজির যে ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ব্যয় হচ্ছে সাধারণ মানুষের মস্তিস্ক প্রক্ষালনের কাজে, তার বহুগুণ জমা হচ্ছে মুনাফার আকারে সেই পুঁজির মালিকদের ভাঁড়ারে। এই পুরো প্রক্রিয়ার প্রায় কোনকিছুই গুণগতভাবে নতুন নয়। তবে পরিমাণগতভাবে এর মাত্রা ব্যাপক। এবং অতি দ্রুত।

ফ্যাসিবাদের কয়েকটি সুস্পষ্ট লক্ষণ আছে — যেমন একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে রাষ্ট্রের নগ্ন উদ্যোগ, সমস্ত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংশাসিত প্রতিষ্ঠানের উপর সরকারি খবরদারি, গণতান্ত্রিক অধিকার সংকোচন, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা, জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ, জাতিসত্তা, বা দেশের নামে উগ্রতা প্রচার, শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-যুব-লিঙ্গসাম্যের আন্দোলনের পরিধি সংকুচিত করা, সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার এবং কার্যত তাদের নাগরিক অধিকারসমূহ কেড়ে নেওয়া ইত্যাদি। বিজেপির গত সাত বছরের শাসনকালে অর্থনীতি রাজনীতি সমাজ সংস্কৃতি— গত সাত বছরের বিজেপি শাসনকালে সর্ব ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন দেখেছি আমরা। কর্পোরেটবন্ধুদের স্বার্থে নোটবন্দী করে দেশের অর্থনীতির শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়া, তিন তালাকের ক্ষেত্রে ফৌজদারী দণ্ডবিধির প্রয়োগ, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা অবলোপ, বাবরি মসজিদ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নজিরবিহীন রায়, বিভিন্ন রাজ্যে লাভ জিহাদ আইন প্রণয়ন, ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতির প্রশ্নে বৈচিত্র্যকে ধূলিলুণ্ঠিত করে একরঙা স্লোগানে মানুষকে উন্মত্ত করে তোলা, মেকি দেশপ্রেমের নামে সমস্ত সমালোচনার কণ্ঠরোধ করা এবং সর্বোপরি সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ২০১৯-এর মাধ্যমে নাগরিকত্ব প্রমাণের এক অসম্ভব দায় চাপিয়ে দেওয়া দেশের পূর্ব প্রান্তের চার-পাঁচটি রাজ্যের অধিবাসীদের ওপর, এবং সেখানেও মুসলমানদের মুখোমুখি করা অন্যায্য বৈষম্যের — এই প্রত্যেকটা পদক্ষেপে ফ্যাসিবাদের ধ্রুপদী ছাপ রয়েছে। বিশেষত গত দেড় বছরে কোভিড মহামারীর সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সংসদীয় গণতন্ত্রের সমস্ত রীতিনীতি লঙ্ঘন করে যেভাবে একের পর এক জনবিরোধী আইন পাশ করিয়েছে, তা এক কথায় নজিরবিহীন।

কৃষক-স্বার্থ বিরোধী তিনটি কৃষি আইন, নয়া শ্রম কোড; ব্যাঙ্ক, বিমা, রেল, কয়লা ইত্যাদি শিল্পের ঢালাও বেসরকারিকরণ, পেট্রল-ডিজেল-রান্নার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি; পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন ও অরণ্যের অধিকার আইনের তরলীকরণ, নয়া শিক্ষানীতি — এর সবকটার উদ্দেশ্যই ছিল ক্রোনি কর্পোরেটদের মুনাফা বাড়ানো। এছাড়াও সামাজিক ক্ষেত্রে এক অদ্ভুত মাৎস্যন্যায় তৈরি হয়েছে। আখলাক, পেহলু খাঁ, আফরাজুল, তবরেজ আনসারির মত সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে স্রেফ মুসলমান হওয়ার “অপরাধে” পিটিয়ে খুন করা হয়েছে। উন্নাও, কাশ্মীর, হাথরাসে জাতীয় পতাকা হাতে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলির মিছিল আমাদের দেখিয়েছে যে ধর্ষণের মত ভয়ানক সামাজিক ব্যাধিকেও প্রাতিষ্ঠানিক করে ফেলা সম্ভব।

শাহীনবাগে নাগরিকত্ব আইন বিরোধী অবস্থানকে কেন্দ্র করে গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রীয় মদতে গণহত্যা চালানো হয় খোদ রাজধানীর বুকে। যারাই এই ফ্যাসিবাদী প্রবণতার প্রতিবাদ করেছেন, তাদের হয় কালবুর্গি, দাভোলকর বা গৌরী লংকেশের মত খুন হতে হয়েছে, নইলে সুধা ভরদ্বাজ, ভারভারা রাও, গৌতম নওলাখা, আনন্দ তেলতুম্বড়ে, কাফিল খান বা উমর খালিদের মত দেশদ্রোহিতার অভিযোগে কারাবন্দী হতে হয়েছে। এমনকি বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতার প্রতিও আর মানুষ আস্থা রাখতে পারছেন না। আমরা দেখেছি, একজন প্রধান বিচারপতি, যাঁর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার মত গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, তিনি অবসর নেওয়ার পর রাজ্যসভায় শাসক দলের দ্বারা মনোনীত হয়েছেন।

এই অবস্থায় কোণঠাসা হতে হতে ভারতবর্ষের মুসলমান সমাজ একটা আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্বে ভুগছে। প্রতিনিয়ত দেশপ্রেমের প্রমাণ দেওয়ার থেকে তারা আজ নিজেদের আত্মপরিচয়কে সজোরে ঘোষণা করতে চাইছে। আর সাধারণ মুসলমানের এই অসহায়তার সুযোগ নিয়েই রমরমা হচ্ছে ক্রুড আইডেন্টিটি পলিটিক্সের। যার ভয়ঙ্করতম রূপ হল গত শতাব্দীর বিশের দশকে হায়দরাবাদের নিজামের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এবং স্বাধীনতার প্রাক্কালে কুখ্যাত রাজাকারবাহিনীর নেতা কাশিম রিজভীর হাত ধরে চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিতে হাত পাকানো অল ইন্ডিয়া মজলিশ এ ইত্তেহাদুল মুসলিমিন বা সংক্ষেপে মিম পার্টি। এর বর্তমান নেতা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষিত, দুরন্ত বাগ্মী আসাদুদ্দিন ওয়েইসি সেই বিশ্বাসঘাতকতার রাজনীতির সুযোগ্য উত্তরসূরী। বৃহৎ পুঁজির সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা রাজনৈতিক মহলে কান পাতলেই শোনা যায়। মহারাষ্ট্র এবং বিহার বিধানসভা নির্বাচনে উগ্র সাম্প্রদায়িক তাস খেলে বিজেপির জয়ের পথ সুগম করেছেন অভিজাত এই আশরাফ মুসলমান। বাংলায় নির্বাচনের আগে ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর সাথে তার বৈঠক চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল সমস্ত প্রগতিশীল মানুষের কপালে।

বামপন্থীদের ডাকা ব্রিগেডের মিটিংয়ে আব্বাস সিদ্দিকীর এন্ট্রি ছিল প্রায় বলিউডি কায়দায়। সস্তা হাততালি কুড়নোর চেষ্টা তাঁর মধ্যে অবশ্যই ছিল। কিন্তু এই যে “তাঁদের ব্রিগেডকে” হঠাৎ করে অন্ত্যজ মানুষেরা কার্যত ছিনিয়ে নিলেন, এটা প্রগতিশীল বাবু বিবিদের অনেকেরই সহ্য হয়নি। আসলে আইনসভায় সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব না থাকার ফল কী বিষময় হতে পারে, তার একটা ঝলক সাচার কমিটির রিপোর্টে আমরা দেখেছি। দিদির আমলে দেখেছি “দুধেল গাই” ট্রিটমেন্ট। হঠাৎ করে আসন সমঝোতায় সংখ্যালঘু-আদিবাসীরা নিজেদের হক দাবি করছে, ভিক্ষে চাইছে না — এটা তো সম্পূর্ণ ভাবে ভদ্রবিত্তদের সিলেবাসের বাইরে ছিল। তাই প্রগতিশীলতার মুখোশগুলো খুলছে, নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তন্ময় ভট্টাচার্যের মত বামপন্থী নেতার বক্তব্যেও সেই হতাশার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে। আব্বাসের রাজনৈতিক বক্তৃতায় শোষিত নিপীড়িত খেটে খাওয়া মানুষের কথা সচেতনভাবেই উঠে আসে, কারণ তাঁর সমর্থনের ভিত্তি মূলত কৃষিজীবী বাঙালি মুসলমান।

একথা মনে রাখা ভাল, আব্বাসের কিন্তু বৃহৎ পুঁজির সাথে যোগ নেই। অতীতে ফ্রান্সে স্যামুয়েল প্যাটির হত্যাকারীর সমর্থনে বা অভিনেত্রী ও সাংসদ নুসরত জাহান সম্পর্কে তাঁর কুকথার তীব্র বিরোধিতা করা সত্ত্বেও জাকির নায়েক বা আসাদুদ্দিন ওয়েইসির সাথে তাঁকে একাসনে বসাতে আমার তীব্র আপত্তি আছে। কারণ তিনি বৃহৎ পুঁজির সাথে সম্পর্কযুক্ত নন, বরং বাংলার শোষিত নিপীড়িত খেটে খাওয়া মুসলমান সমাজ তাঁর মূল জনভিত্তি। ফলে তাদের রুটি রুজির প্রশ্নে কথা বলতে আব্বাস বাধ্য।

ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, দেশব্যাপী চলমান কৃষক আন্দোলনে হরিয়ানা-পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের খাপ পঞ্চায়েতগুলো কৃষকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। সেই পিতৃতান্ত্রিক ভাবনায় জারিত খাপ পঞ্চায়েত, যারা তাদের উগ্র ও পশ্চাদমুখী সংস্কৃতি ও কাজের জন্য “কুখ্যাত”। ২৬শে জানুয়ারিতে লালকেল্লার ঘটনার পর যখন সমগ্র সরকারি ও কর্পোরেট প্রচারযন্ত্র ঝাঁপিয়ে পড়েছে চাষীদের “দেশদ্রোহী” প্রমাণের কাজে, তখন বিকেইউ নেতা রাকেশ টিকায়েতের কান্না লক্ষ লক্ষ জাঠ কৃষককে ঐক্যবদ্ধ করেছে। মুজফফরনগর দাঙ্গায় এই রাকেশ-নরেশ ভ্রাতৃদ্বয়ের ন্যক্কারজনক ভূমিকা ছিল। কার্যত বিজেপির হাতের পুতুল হয়ে জাঠ কৃষকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পাঁচিল তোলার কাজ করেছিলেন তাঁরা। আজ সেই রাকেশ টিকায়েত ফ্যাসিবাদী সরকারের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন, কৃষক আন্দোলনের একজন সর্বজনস্বীকৃত আইকন হয়ে উঠেছেন। তা বলে কি আমরা তাঁর অতীত, বা খাপ পঞ্চায়েতের পশ্চাদমুখী সংস্কৃতির সমালোচনা করব না? অবশ্যই করব, শুধু তাই নয়, সতর্কও থাকব যাতে আন্দোলনের রাশ পুরোপুরি প্রগতিশীল কৃষক সমাজের হাতেই থাকে। কিন্তু তা বলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় তাঁকে বাদ দেব না। একই কথা প্রযোজ্য আব্বাস সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে। ফুরফুরা শরীফের এই পীরজাদাটির রাজনৈতিক উত্থান এবং দলিত ও আদিবাসীদের নিয়ে সেকুলার ফ্রন্ট গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে বাংলায় আত্মপরিচয়কেন্দ্রিক রাজনীতির একটা নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়েছে।

বিজেপি শাসন গত সাত বছরে মুসলমানদের মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছিল, একদিকে তার ফায়দা তোলা শুরু করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আর অন্যদিকে মতুয়া, রাজবংশী সহ বিভিন্ন নিপীড়িত সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষের চাষ শুরু করল আরএসএস-বিজেপি। প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের খারাপ ফলের পর থেকেই রাজ্যে আরএসএস পরিচালিত সংস্থাগুলো ব্যাঙের ছাতার মতো বাড়তে শুরু করে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে তাতে সক্রিয়ভাবে মদত দেন। একইসঙ্গে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে অসরকারি খারিজি মাদ্রাসার সংখ্যা চোখে পড়ার মত বৃদ্ধি পায়, এবং সেগুলো মূলত ব্যবহৃত হয় ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা ছড়ানোর কাজে। ফলে রাজ্য সাম্প্রদায়িক বারুদের স্তূপের উপরেই বসে ছিল। যার ফল আমরা দেখি ধুলাগড়, বসিরহাট, কালিয়াচক, দত্তপুকুরে। অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় প্রশাসনের নাকের ডগায় দাঙ্গা বাধানো হয় প্রতিটি ক্ষেত্রে। সাধারণ খেটে খাওয়া হিন্দু ও মুসলমান মানুষের প্রাণ ও সম্পত্তি নষ্ট হওয়ার সাথে সাথে ধর্মের ভিত্তিতে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করা হয় গোটা রাজ্যে। কর্পোরেট মিডিয়া এবং বিজেপির আই টি সেল ধর্মীয় বিদ্বেষ পৌঁছে দেয় বাংলার ঘরে ঘরে। অর্থনৈতিক দুর্দশা, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ব্যর্থতার মত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু চাপা পড়ে যায় মেরুকরণের বাতাবরণে, ফলে রুটি রুজি ও অধিকারের প্রশ্নে বামপন্থীদের তোলা জরুরি প্রশ্নগুলো ভোটের বাজারে মানুষের কাছে পর্যাপ্তভাবে পৌঁছয় না। অন্যদিকে সঙ্কটগ্রস্ত, বিপন্ন জনগণের মৌলিক সমস্যাগুলির সুরাহা করতে না পারলেও রাজ্য সরকার বিনামূল্যে রেশন, দুয়ারে সরকার, কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী ইত্যাদির মাধ্যমে প্রান্তিক, গরিব এবং শ্রমজীবী মানুষকে কিছু তাৎক্ষণিক সুরাহা পৌঁছে দিয়েছে। এর ফলে শাসক দলের হৃত জনসমর্থন শুধু ফেরতই আসেনি, খানিকটা বেড়েছে।

বিশ্ব রাজনীতির দিকে চোখ রাখলে একটা কথা দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে যায় — মানুষ কিন্তু আত্মপরিচয়ের কারণে নিপীড়ন মেনে নিতে আর রাজি নন। এটা বুঝতে হবে যে মানুষ বিভিন্ন কারণে নিপীড়িত হন, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের আত্মপরিচয়ের বিবিধ স্তরের ওপর সেই নিপীড়নের মাত্রা নির্ভর করে। এক নিপীড়িত শ্রমিকের একই সঙ্গে নারী, মুসলমান এবং বাঙালি আইডেন্টিটি তাঁর নিপীড়নের মাত্রাকে অনেকাংশে বাড়িয়ে তুলতে পারে। এত বিবিধ পরিচয় এক জটিল বিন্যাস তৈরী করে। প্রশ্ন হল কোন পরিচয়ে তিনি রুখে দাঁড়াবেন? এক নারী হিসাবে নিজের সমানাধিকার দাবী করতে হিজাব-বোরখা তিনি কি সরিয়ে দেবেন, নাকি মুসলমানদের ওপর বিশ্বজোড়া পশ্চিমী পুঁজির হাতধরা পশ্চিমী সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে হিজাব-বোরখাই হবে তাঁর আত্মপরিচয়? আরও গভীর প্রশ্ন হল একজন দলিত কিংবা আদিবাসী রমণী কোন প্রশ্নে হিজাব-বোরখা পরেই আত্মমর্যাদার লড়াই লড়তে থাকা জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ছাত্রীটির সাথে একাত্ম হবেন? আরও একটা প্রশ্ন হল, এক গরীব হিন্দু চাষী একজন গরীব মুসলিম চাষীর ওপর চলা মুসলিমবিরোধী নিপীড়নের প্রশ্নে কী ভূমিকা নেবেন? এই প্রশ্নগুলো জটিল, আর এর বস্তুবাদী উত্তর খোঁজাই আগামীদিনের বামপন্থী ভাষ্য নির্মাণের চাবিকাঠি হতে চলেছে। তৃণমূলের সেসব দায় নেই, ফলত তারা বিশুদ্ধ খয়রাতি রাজনীতির মাধ্যমে ভোটব্যাঙ্ক পলিটিক্সে নিজেদের আবদ্ধ রাখবে, এটাই ধরে নেওয়া যায়। শ্রেণী রাজনীতির সাথে অবদমিত জাতিসত্তাভিত্তিক রাজনৈতিক বীক্ষণের মেলবন্ধন গড়ে তোলাই তাই বর্তমানে সৃজনশীল বামপন্থার সামনে বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ। প্রশ্ন হলো, চেনা প্রশ্নপত্রের বাইরে বেরিয়ে এই দুরূহ রাজনৈতিক পরীক্ষা নিরীক্ষায় আদৌ আমাদের রাজ্যের বামপন্থীরা উৎসাহী হবেন কি?

(এই লেখাটি নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত হয়েছে। Alternative Viewpoint এ পুনঃপ্রকাশ করা হলো।)

More From Author

Peasant mobilizations against backdrop of agrarian crisis

Did India really win its independence through non-violence?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *