
“ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর সমর্থক রেজা পাহলভি ও তার নেতৃত্বাধীন বিরোধী মনার্কিস্ট দল ইরানে বিমান হামলার পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। আক্রমণের মাধ্যমে ‘মুক্ত’ করার ইসারেলের এই দাবির প্রতি তাঁর সমর্থন সাধারণ মানুষের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে,” অলটারনেটিভ ভিউপয়েন্টের ফারুক সুলেহরিয়াকে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন ফ্রিদা আফারি।
ফ্রিদা আফারি একজন ইরানিয়ান-আমেরিকান সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী রাজনৈতিক কর্মী, অনুবাদক ও লেখিকা। তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসে একজন গণগ্রন্থাগারিক হিসেবে কাজ করেন এবং সেখানে তিনি দর্শন ও রাজনীতির ক্লাস পরিচালনা করেন। এই ক্লাসে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার, লাতিনা, কুইয়ার ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা রাজনৈতিক কর্মী সহ নানা প্রগতিশীল নারী ও তরুণ শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। তিনি তাঁর ব্লগ ‘ইরানিয়ান প্রগ্রেসিভস ইন ট্রান্সলেশন’-এর মাধ্যমেও কাজ করেন।
আপনি কী ইরানের যুদ্ধ-পূর্ব ও পরবর্তী রাজনৈতিক চিত্র ব্যাখ্যা করে বলবেন? ইরানি সরকার কি একে বিজয় হিসেবে উদযাপন করছে? জনগণ এই যুদ্ধকে কিভাবে দেখছে?
ইসরায়েল ১৩ জুন থেকে ইরানে বোমা হামলা শুরু করার আগে, ইরানের জনগণের একটা বড় অংশ, সরকারকে ঘৃণা করলেও আশা করেছিল যে এই সরকার ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করতে পারবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞাগুলি প্রত্যাহার করবে। ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার বোঝা চাপানোর ফলে ইরানি জনগণের জন্য জীবন দুর্বিষহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৩ জুন আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) জানায় যে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করার মতো যথেষ্ট পরিমাণে ইউরেনিয়ামে সমৃদ্ধ। এরপরে ইরান যখন মার্কিন প্রশাসন প্রস্তাবিত যৌথ পরমাণু সমৃদ্ধিকরণ চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে, তখন ইসরায়েল এই ঘটনাগুলোকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ব্যাপক বোমা হামলা শুরু করে।
১৩ জুন থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত ইসরায়েল যে বিমান হামলা চালায় তা পারমাণবিক কেন্দ্র, বন্দর, আবাসিক এলাকা এবং ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (IRGC)-এর সঙ্গে ঘাটিগুলোর ওপর আঘাত হানে। সেইসাথে ইসরায়েল ইরানের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের তাঁদের বাড়িতেই হত্যা করে।
২২ জুনে মার্কিন বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমানগুলি বাংকার বাস্টার বোমা ফেলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। শুধু ইরানের পারমাণবিক এবং জ্বালানি ক্ষেত্রই নয়, সাধারণ বাসিন্দাদের আবাসন, জল ও খাদ্য পরিকাঠামোও ধ্বংস হয়ে যায়। সরকারি হিসাবেই ৯০০ জনের বেশি মানুষ নিহত এবং ৪০০০-এর বেশি আহত হন। ইসরায়েল এমনকি এভিন কারাগারে বোমা নিক্ষেপ করে যেখানে বহু প্রগতিশীল রাজনৈতিক বন্দী বিশেষ করে নারী অধিকারকর্মীরা আটক ছিলেন।
এই ধ্বংসযজ্ঞ ও পরবর্তী দমনপীড়নের ফলে জনগণ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
এই যুদ্ধ ইরানি শাসনব্যবস্থার ওপর কী প্রভাব ফেলবে?
ইরানের সরকার টিকে গেলেও তা দুর্বল হয়েছে। ইসরায়েলের হাতে এত সংখ্যক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, IRGC সদস্য ও বিজ্ঞানী নিহত হওয়া এই সরকারের দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয়। যদিও তাদের বেশ কিছু মিত্র পরাস্ত হয়েছে — যেমন আসাদ সরকার (সিরিয়া), হিজবুল্লাহ (লেবানন), হুথি বিদ্রোহীরা (ইয়েমেন) — তবুও এখনো ইরাক, লেবানন ও ইয়েমেনে কিছু শক্তিশালী গোষ্ঠীর ওপর ইরানের প্রভাব বজায় আছে। এছাড়াও, ইরান এখনো হরমুজ প্রণালী অবরোধ করার ক্ষমতা রাখে যে পথ দিয়ে এশিয়া এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশে জ্বালানি পরিবহন হয়। তারা ব্যালিস্টিক মিসাইল, ড্রোন, এবং শর্ট-রেঞ্জ অস্ত্রের অধিকারী। রাশিয়া ও চীন তাদের সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। রাশিয়াকে তারা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করে এবং তাদের কাছ থেকে পরমাণু বিদ্যুৎ প্রযুক্তি ও অস্ত্র সংগ্রহ করে।
বর্তমান শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে দেশের ভিতরে এবং বাইরে প্রবাসী ইরানী সাধারণ মানুষের ধারণা কী? সম্প্রতি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর আয়াতোল্লাদের বৈধতা কি বেড়েছে?
উত্তর: ইরানের অন্তত ৮০ শতাংশ জনগণ বর্তমান শাসনব্যবস্থার বিরোধী। তাঁরা এই সরকারকে দুর্নীতিগ্রস্ত, শোষণমূলক এবং সামরিকীকরণে আগ্রহী বলে মনে করেন। তাঁরা মনে করেন বৃহত্তর জনগণের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে এদের কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। আজ ইরানের জনগণের এক বড় অংশ ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণের দাবি তুলে ধর্মীয় মৌলবাদী শাসনব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করছেন। প্রবাসী ইরানিদের মধ্যেও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরোধিতা দীর্ঘদিনের।
সরকার নানা সময়ে বড় বড় শোকসভা আয়োজন করে এই ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করতে চায় যে তাদের পেছনে ব্যাপক গণসমর্থন আছে। কিন্তু বাস্তবে তাদের প্রকৃত সমর্থকদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের বেশি নয়। সাম্প্রতিক ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলার সময় দেখা গেছে যে সরকার লেবাননে শত শত মাইল দীর্ঘ ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ নির্মাণ করলেও ইরানের সাধারণ নাগরিকদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের কোনও ব্যবস্থা করতে পারেনি। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের সার্বিক ব্যর্থতা স্পষ্ট। যুদ্ধ শুরুর আগেই বাড়ি ভাড়া ও খাদ্যের দাম আকাশছোঁয়া ছিল, তা আরও বেড়েছে। পাশাপাশি, আগেই জল-সমস্যা প্রচণ্ড সংকট সৃষ্টি করেছিল। এখন তা আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
সরকার-বিরোধী আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের এখন কীরকম অবস্থা?
সরকারি বক্তব্য অনুযায়ী যুদ্ধবিরতির পর ৭০০ জনকে ‘ইসরায়েলি গুপ্তচর’ অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। অনেকেই কুর্দি, আফগান ও বাহাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যুবক যাদের অনেকেই ২০২২-২৩ সালের ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা আন্দোলন’- এ অংশ নিয়েছিলেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, গ্রেপ্তারের মোট সংখ্যা ৯০০-এর বেশি হতে পারে। বহু রাজনৈতিক বন্দীকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। ড. আহমদ রেজা জালালি, এক সুইডিশ-ইরানি চিকিৎসক ও গবেষক বিগত কয়েক বছর ধরে মিথ্যা অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত। এই দণ্ড যে কোন সময়ে কার্যকর হতে পারে।
এভিন কারাগারে ইসরায়েলি হামলায় ৭১ জন নিহত হয়েছেন। যেসব রাজনৈতিক বন্দী বেঁচে ছিলেন, তাদের অনেককে ঘারচাক কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে যেখানকার পরিবেশ অমানবিক এবং সেখানে কয়েদীদের দুষিত লবনাক্ত জল খেয়ে টিকে থাকতে হয়।
বোমাবর্ষণের পরেই ইরানে শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার, নারী অধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং ছাত্র সংগঠনের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লড়াইয়ের ওপর দমনপীড়নের মাত্রা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বহু প্রগতিশীল নেতৃত্বের প্রাণনাশের আশঙ্কাও সুস্পষ্ট।
ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর সমর্থক ভূতপূর্ব শাসক পরিবারের বংশধর রেজা পাহলভি ও তার নেতৃত্বাধীন বিরোধী মনার্কিস্ট দল ইরানে বিমান হামলার পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। সাধারণ জনগণ তার মার্কিন-ইসরায়েলি আক্রমণের মাধ্যমে ইরানের “মুক্তি”র দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। “এতদসত্ত্বেও” পহলভি মার্কিন ও ইসরায়েলি বোমা হামলাগুলোর নিন্দা না করে তাদের প্রশংসা করেছেন এবং নিজেকে ইরানের ভবিষ্যৎ শাসক হিসেবে দাবি করেছেন। তার এই অবস্থান তাঁর বিকৃত রাজতান্ত্রিক আগ্রাসনবাদী মনোভাবের প্রকৃত পরিচায়ক।
ইরানে বা নির্বাসনে তুদেহ পার্টি ও অন্যান্য বামপন্থী সংগঠনের বর্তমান ভূমিকা কী? বামপন্থার ভবিষ্যৎ পথই বা কী হতে পারে?
১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর খোমেনিকে ও ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে “সাম্রাজ্যবাদ–বিরোধী” বলে সমর্থন করে তুদেহ পার্টি তার বিপুল রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা হারায়। ১৯৮৩ সালে তাদের শীর্ষ নেতৃত্ব গ্রেপ্তার হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের এই সমর্থন তারা বজায় রেখেছিল । এরপর ১৯৮৪ সালে ও পরে তুদেহ পার্টির একাধিক সদস্যকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
ইরানের ভিতরে আরও কিছু ছোট ছোট বাম সংগঠন রয়েছে যারা শ্রমিক ও নারীর অধিকারের লড়াইয়ে, বিশেষ করে “নারী, জীবন, স্বাধীনতা আন্দোলনে” সক্রিয় ছিল — এই আন্দোলনটি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের শুরু পর্যন্ত চলেছিল। কিছু তরুণ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী মার্ক্স ও পরবর্তী মার্ক্সবাদী লেখকদের লেখাপত্র পড়ে ও আলোচনা করে বামপন্থী ভাবনাচিন্তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
ইরান ও বাইরের প্রগতিশীল অংশের একাধিক বিবৃতিতে এই যুদ্ধে ইসরায়েল/যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান—উভয়ের ভূমিকার সমানভাবে নিন্দা করা হয়েছে। বোমাবর্ষণের পর নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী নারগেস মোহাম্মদি ও শিরিন এবাদি এবং বেশ কয়েকজন ইরানিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা একটি বিবৃতি জারি করে পারমাণবিক শক্তি ও যুদ্ধের বিরোধিতা করে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের অবসানের ডাক দেন। ইরানের ভেতরের শ্রমিক ও লেখক সংগঠনগুলিও এই যুদ্ধে যুক্ত সমস্ত শক্তির বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছে। ইরান ও বিদেশের বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীরাও একটি বিবৃতি দিয়ে একই রকম নীতিগত অবস্থান গ্রহণ করেছেন। একইসাথে ইরানের প্রগতিশীলদের সমালোচনা করা হয়েছে কারণ গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক পরিসরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও তারা এর বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেয়নি। এই বিবৃতির অনুবাদ পাওয়া যাবে iranianprogressives.org ওয়েবসাইটে।
ট্রাম্পের আচরণের পূর্বানুমান করা কঠিন, কিন্তু আপনি কি মনে করেন আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে কোনো ধরনের মীমাংসা সম্ভব? এবং সেক্ষেত্রে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের একটা আপসের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী কোনো সমঝোতায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা খুবই কম কারণ ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসলামি প্রজাতন্ত্রের রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল উপাদানই ছিল আমেরিকা ও ইসরায়েল বিরোধিতা। উপরন্তু ইরান এখন রাশিয়া ও চীনের পাশাপাশি BRICS জোটের সদস্য।
আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (IAEA) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি জানিয়েছেন যে ইরান কেবল তার পারমাণবিক কর্মসুচী কয়েক মাসের জন্যই স্থগিত করেছে। মূল বিষয় হল যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল — উভয়ের কাছেই পরমাণু অস্ত্র রয়েছে অথচ ইসরায়েল এখনও পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (Nuclear Non-Proliferation Treaty)-তে স্বাক্ষর করেনি। তদুপরি ইসরায়েল ও আমেরিকা গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে চরম আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে যা তাদের তথাকথিত নৈতিক উচ্চতা প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সার্বিকভাবে এই সংঘাতে সমস্ত পক্ষের সামরিকবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, স্বৈরতন্ত্র এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরোধিতা করে প্রগতিশীলদের নীতিগত অবস্থান নিতে হবে।