
BURKINA FASO - FEBRUARY 01: Captain Thomas Sankara, leader of Burkina Faso. (Photo by William F. Campbell/Getty Images)
মালি দেশের এক জোরালো স্বর সেদেশে জায়মান সার্বভৌমত্বের মিথ ভেঙে নতুন করে তৈরি হওয়া অবদমন চক্রের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন,যে অবদমন চক্রের নতুন নাম “সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা”।
[বুর্কিনা ফাসো, মালি এবং নাইজারের সামরিক জুন্টাগুলি নিজেদেরকে এক নতুন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার অগ্রদূত হিসেবে তুলে ধরছে। ফরাসি সেনাদের বিতাড়ন, খনি দখল, এবং টমাস সাঙ্কারার নাম ও ঐতিহ্যের ব্যবহার করে তারা এক শক্তিশালী সার্বভৌমত্বের বয়ান প্রস্তুত করেছে যা আফ্রিকা এবং তার বাইরেও সাড়া ফেলেছে। কিন্তু এই স্লোগানের তলায় চাপা পড়ছে বয়ানের তীব্র বিরোধী বাস্তব। সামরিক শাসন সুসংহত হচ্ছে, গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি সংকুচিত হচ্ছে, কৃষক-শ্রমিক ও বেকার তরুণ নিজস্ব ভবিষ্যৎ গঠনের প্রক্রিয়া থেকে নিজেরাই বাদ পড়ে যাচ্ছেন।
সাহেলের আজকের সংকট এই দ্বন্দ্বেই নিহিত: সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অঙ্গীকারের পাশাপাশি চলছে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা, যা শেষ পর্যন্ত সেই একই দাসত্ব পুনরুৎপাদন করছে যাকে সামরিক শাসক নিজেই প্রতিরোধ করার দাবি তোলে। সাধারণ মানুষের জন্য ঘোষিত মুক্তি এখনও অধরাই রয়ে গেছে।
এই প্রেক্ষিতে অল্টারনেটিভ ভিউপয়েন্ট কথা বলেছে এক তরুণ মালিয়ান কৃষক ও অ্যাক্টিভিস্ট —সিনামবান কুলিবালি-র সাথে। তিনি স্বনামে কথা বলতে পারছেন না।কারণ ভিন্নমতাবলম্বীদের গ্রেফতার, দমন কিংবা নির্বাসনের হুমকি পরিস্থিতির মধ্যে এছাড়া আর কোন পথ নেই। যে অকপট অভিজ্ঞতা তিনি ভাগ করে নিয়েছেন তা আমাদের আবারও স্মরণ করায় – প্রকৃত মুক্তি জেনারেলদের ঘোষণায় আসে না, বরং থাকবন্দী সমাজের নিচুতলার সংগ্রামের ভেতর দিয়েই তার অর্জন সম্ভব।একদিন তা অর্জিত হবে, সেদিন সিনামবান স্বনামে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেবেন তাঁর স্বর। –সম্পাদকমণ্ডলী]
অল্টারনেটিভ ভিউপয়েন্ট : সেনারা ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে বাজারদর, কাজ, স্কুল ও স্বাস্থ্য—এইসব ক্ষেত্রে আপনার এবং আশেপাশের মানুষের জীবনে কী পরিবর্তন এসেছে?
সিনামবান: আগস্ট ২০২০-তে সামরিক বাহিনী প্রথমে মানুষের মধ্যে প্রভূত আশার সঞ্চার করেছিল। জনগণ তখন বহুবিধ সংগ্রামে ক্লান্ত ও জর্জরিত , বিশেষ করে চরম নিরাপত্তাহীনতা। কিন্তু খুব দ্রুতই সরকার তার অক্ষমতা ও ফলস্বরূপ স্বৈরাচারী চরিত্র প্রকাশ করে ফেলল।
আমাদের পূর্বেকার অনিশ্চিত জীবনযাত্রার আরও অবনতি হয়েছে। আগে যে নিরাপত্তাহীনতা মূলত উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা গোটা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষত গ্রামীণ এলাকায়। কৃষক, পশুপালক ও মৎস্যজীবীরা কার্যত রাষ্ট্রবহির্ভূত সশস্ত্র গোষ্ঠীর মুঠোবন্দী হয়ে পড়েছে। ফলে আমরা কাজের পরিসর সংকুচিত হয়ে কাজ করতেই অক্ষম হয়ে পড়ছি।
শহুরে জনগণ, যারা ক্ষুদ্র শিল্প, ব্যবসা ও দৈহিক পরিশ্রমের ওপর নির্ভর করে, তারা এখন নজিরবিহীন বিদ্যুৎ সংকটে পড়েছে। কিছু শহরে দীর্ঘস্থায়ী লোডশেডিং চলছে, মানুষকে প্রতিদিন” দিন আনা দিন খাওয়া পরিস্থিতিতে”ঠেলে দিচ্ছে। দিনের আয়ে রাতের খাবার জোটানোই এখনকার বাস্তবতা। অর্থনৈতিক ক্রিয়াশীলতা প্রায় থেমে গেছে।
শহরগুলো গ্রামীণ উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু প্রায়ই তাদের ক্রয়ক্ষমতা থাকে না। এই ক্রয়ক্ষমতার অভাব কৃষি উৎপাদকদের বাধ্য করছে পণ্য অতি কম দামে বিক্রি করতে। তাছাড়া, গ্রামীণ জনগণের পণ্য সংরক্ষণের সুযোগ-সুবিধা নেই, ফলে বিক্রি না হলে তা নষ্ট হয়ে যায়।
অস্ত্রধারী গোষ্ঠী অনেক গ্রাম দখল করে নিয়েছে, যার ফলে হাজার হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। এই সংকট উত্তর ও মধ্যাঞ্চল প্রায় সব এলাকাকেই প্রভাবিত করছে, এবং অন্য অনেক অঞ্চলকেও। তাছাড়া, অভিভাবকেরা সরাসরি যে কমিউনিটি শিক্ষক নিয়োগ করেন, তাদের বেতন দিতে না পারায় শত শত সরকারি শিক্ষায়তন বন্ধ হয়ে গেছে। রাষ্ট্র পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করছে না।
স্বাস্থ্য খাতেও একই সংকট। স্বাস্থ্যব্যবস্থা ক্রমশ বেসরকারীকরণের দিকে চলে যাচ্ছে। আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে মানুষ চিকিৎসাকেন্দ্রে যায় না।
কমান্ডে থাকা সামরিক বাহিনী কেবল দমননীতি প্রয়োগ করেছে।
অ.ভি : আপনি যখন ইব্রাহিম ত্রাওরের শাসনে বুর্কিনা ফাসোর পরিস্থিতি তুলনা করেন, তখন কি কোনো তফাৎ খুঁজে পান? নাকি মালিয়ানদের অভিজ্ঞতার সাথেই এর মিল বেশি?
সিনামবান: আমি যখন বুর্কিনা ফাসোর পরিস্থিতি বিচার করি, তখন মালির বাস্তবতার সাথে কোনো ভিন্নতা দেখতে পাই না। আমার মতে, উভয় দেশের পরিস্থিতি অভিন্ন। বুর্কিনার অনেক গ্রামবাসী মালির ভেতরে এসে বসতি স্থাপন করছে, আবার মালি থেকেও লোকজন ‘অপেক্ষাকৃত শান্তি’পূর্ণ এলাকা খুঁজে বসতি গড়ার চেষ্টা করছে।
“জাতীয় সার্বভৌমত্ব” নিয়ে প্রচুর কথা বলা হয়। কিন্তু একজন কৃষক পরিবারের জন্য বা বামাকোর একজন তরুণ শ্রমিকের জন্য এর অর্থ আসলে কী? প্রথমে মানুষ এইসব অস্পষ্ট কথাবার্তায় আস্থা রেখেছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এটা এখন কৌতুকে পরিণত হয়েছে। মানুষের আসল আকাঙ্ক্ষা হলো ক্ষুধা ও তৃষ্ণা থেকে মুক্তি। তারা চায় গুলির শব্দ থেমে যাক।
অ.ভি : বুর্কিনা ফাসোতে ত্রাওরে “জাতীয় ভাষা প্রচার” ও ফরাসি-বিরোধী কথাবার্তা বলেন। এগুলো কি সত্যিই মানুষের জীবনে কোনো পরিবর্তন আনে, নাকি শুধু প্রতীকী পদক্ষেপ?
উত্তর: এগুলো কিছুই বদলায় না, এমনকি প্রতীকীও নয়। আমরা তো জানি আমাদের দেশে কোন ভাষাগুলো প্রচলিত, তাহলে সেগুলো সবকটাই কেন সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না? যদি সব ভাষাকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হতো, তাহলে ‘একক ব্যবহারিক ভাষা’ নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি থাকত না। এই প্রচার ইচ্ছাকৃত বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য। ফরাসি ভাষার আধিপত্যই কায়েম রয়েছে।
“ফ্রান্স” নামটাকে ব্যবহার করার দস্তুরটাই তাদের প্রধান চালাকি। “ফ্রান্স” কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ বা শাসনব্যবস্থার প্রতীক নয়। যে নব্য-উদারবাদ আমাদের আফ্রিকান জনগণকে শোষণ করছে, ফরাসি জনগণও সেই একই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এই ফরাসি-বিরোধী বাগাড়ম্বর কেবল স্থানীয় অলিগার্কদের ক্ষমতা আরও সংহত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। ফ্রান্স চলে গেছে, দারিদ্র্য রয়ে গেছে,তা কেবল বেড়েই চলেছে।
অ.ভি : মালি সরকার দাবি করছে যে জিহাদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রগতি হচ্ছে। কিন্তু গ্রাম ও গ্রামীণ এলাকায় মানুষ কি বেশি নিরাপদ বোধ করছে, নাকি আরও ভীত?
সিনামবান: মানুষের ভয় বললে কম বলা হবে,মানুষ ভীত ও চরম সন্ত্রস্ত। গ্রামগুলো বাধ্য হচ্ছে এই গোষ্ঠীগুলোর দাবি মানতে, যাতে হামলার শিকার না হতে হয়। সম্প্রতি এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো প্রকাশ্যে ভিডিও ছেড়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে, কিছু কাজ নিষিদ্ধ করেছে। নিষেধ অমান্য করলে শাস্তি কার্যকর করছে। আমরা আতঙ্কে বাস করছি।
অ.ভি : বাস্তুচ্যুত মানুষ, পশুপালক ও গ্রামীণ পরিবারগুলি কি কোনো সুরক্ষা অনুভব করছে?
সিনামবান: গ্রাম হোক বা শহর—সবখানেই মানুষ ভয় পায়।
অ.ভি: নির্বাচন বেশ কয়েকবার পিছিয়ে গেছে। আপনি বা আপনার আশেপাশের মানুষেরা এসবের সাথে কিভাবে মানিয়ে নিচ্ছেন ?
সিনামবান : মানুষ সম্পূর্ণ হতাশ। শুরুতে, ২০২১ সালের মে মাসে দ্বিতীয় জরুরি অবস্থার সময় চগুয়েল কোকালা মালগা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সরকার তার কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটিকে অবজ্ঞা করতেই মনোযোগী ছিল। এখানে সরকার একবার নিজেদের নিরাপদ মনে করলে রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোকে বিলুপ্ত করে দেয়। বেড়ে চলা গভীর নিরাপত্তাহীনতা এবং সেনাবাহিনীর দমনপীড়ন শেষ পর্যন্ত সরকারের স্বৈরাচারী ও স্বাধীনতাবিরোধী চরিত্রকে সবার সামনে স্পষ্ট করে তোলে—এমনকি তাদের কাছেও যারা একে প্রথমে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি।
অ.ভি: আপনি কি মনে করেন জুন্তা শীঘ্রই ক্ষমতা ছাড়বে, নাকি দীর্ঘ সময় ধরে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে?
সিনামবান : তারা নিজেদেরকে ইতিমধ্যেই চিরস্থায়ী সাম্রাজ্য বলে ভাবছে।
অ.ভি: রাজনৈতিক দল, ইউনিয়ন ও সংগঠনগুলোর কি এখনও কাজ করার জায়গা অবশিষ্ট আছে, নাকি সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেছে?
সিনামবান: আপাতত সবই স্তব্ধ। দলগুলো বিলুপ্তির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল, কিন্তু রাজধানীর কয়েকটি আদালত নিজেদেরই কাজ করতে অযোগ্য বলে ঘোষণা করে। তবে কম্যুন ১আদালত বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে সাংবিধানিক আদালতে পাঠায় গত আগস্টে। আমাদের কি আর স্বাধীন সাংবিধানিক আদালত আছে? আদালত ইতিমধ্যেই পূর্ববর্তী অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তগুলো পাস করতে দিয়েছে। তবে শ্রমিক ইউনিয়ন ও অ-রাজনৈতিক সংগঠনগুলো শেষ পর্যন্ত রেহাই পেয়েছে।
অ.ভি: আপনারা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষিতে কাটছাঁট ইত্যাদিতে কি চাপ অনুভব করছেন বা কতটা চাপ অনুভব করছেন?
সিনামবান : অবশ্যই, আমরা সেই চাপ অনুভব করছি। আমরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও স্কুল নিয়ে ভীষণ উদবিগ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সময়মতো তাদের বৃত্তি পায় না। ফলে তারা তিন বছর ধরে একই ক্লাসে থেকে যায়, পরবর্তী স্তরে উঠতে পারে না, কারণ পাঠক্রমে নিয়মিত ব্যাঘাত ঘটে। SNESUP (ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব হাইয়ার এডুকেশন) প্রায় স্থায়ী ধর্মঘটে আছে–ভালো কাজের পরিবেশ, আরও শিক্ষক নিয়োগ এবং পর্যাপ্ত লেকচার হলের দাবিতে।
স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার ইউনিয়নগুলো একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি, যদিও তারা তাদের সামাজিক দায়িত্বের কারণে দীর্ঘস্থায়ী ধর্মঘট চালিয়ে যেতে পারে না। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ধর্মঘটগুলো এই সংকটকে আরও স্পষ্ট করে তুলছে।
কৃষি পরিস্থিতি ভয়াবহ। অনেক তুলোচাষি গত মরশুমের ফসলের টাকা পাননি। তাছাড়া, এ মরশুমের খাদ্যশস্যের জন্য প্রয়োজনীয় সার ও ইনপুট যথাসময়ে এবং
যথেষ্ট পরিমাণে সরবরাহ করা হয়নি। শস্য উৎপাদকরা আগামী বছরে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে আছেন। আমরা এখন ফসল কাটার মাত্র দেড় মাস দূরে, অথচ এখনও সার মাঠে পৌঁছেনি। আমি জোর দিয়ে বলছি, যে পরিমাণ সার এসেছে তা মোটেই যথেষ্ট নয়। এটা একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি।
উৎপাদকদের সার প্রস্তুতির জন্য কোনো সহায়তা নেই। উপরন্তু,যে কথাটা বলা দরকার, শাসকরা এই ধার করা অর্থের মারাত্মক নয়ছয় করেছে।
অ.ভি: ফ্রান্সের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার ফলে কি বাস্তব কোনো অর্থনৈতিক পরিবর্তন এসেছে, নাকি IMF, বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য অংশীদারদের ওপর নির্ভরতা আগের মতোই আছে?
সিনামবান : আমি আগেই বলেছি, ফ্রান্সকে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ বা শাসনব্যবস্থা হিসেবে দেখা উচিত নয়। আমাদের নির্ভরতা এই অংশীদারদের ওপর আগের মতোই আছে। প্রতিদিন আমাদের রাষ্ট্র IMF ও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের প্রথম কোয়ার্টারের শেষে—বিশেষ করে এপ্রিল মাসে—IMF ১২ কোটি ডলার জরুরি অর্থায়ন করেছিল “খাদ্য আমদানির জরুরি প্রয়োজন মেটানো এবং অর্থব্যবস্থায় টাকার যোগান নিশ্চিত করার জন্য।”
এক বছর পরে, ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে, IMF ১২.৯ কোটি ডলার মঞ্জুর করেছে Rapid Credit Facility (RCF)-এর আওতায়, বন্যার দুর্দশা মোকাবিলার জন্য।
বিশ্বব্যাংক ২০২১ সালের অক্টোবরে মালির সাথে এক চুক্তি করে, যার উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ-সংযোগ এবং সড়ক পরিবহনে উন্নতি সাধন।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে আরও দুটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার মোট পরিমাণ ১৮৮.২৬ বিলিয়ন CFA ফ্রাঁ। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ১০ কোটি ডলারের ঋণ দেয় পানীয় জলের প্রাপ্তি বৃদ্ধির জন্য। এই উদাহরণগুলোই প্রমাণ করে যে, দেশে তাদের আর্থিক প্রভাব আগের মতোই বিদ্যমান।
অন্য কোনো উল্লেখযোগ্য অংশীদার নেই, বিশ্বব্যাংক ছাড়া। অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া, চীন ও তুরস্ক কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে তা অত্যন্ত অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া। নাগরিকরা জানেই না এই চুক্তিগুলোর শর্ত কী। এই দেশগুলো খনিজ উত্তোলন খাতেও চাপ দিচ্ছে। বিশেষ করে চীন, যা অবাধে আমাদের পরিবেশ ধ্বংস করছে এবং পরিবেশ-রক্ষাকারী প্রতিরোধী জনগোষ্ঠীর ক্ষতি করছে। এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যাবে পশ্চিমাঞ্চলের কিতা অঞ্চলের কেএনিবা, দক্ষিণ-পশ্চিমের কুলিকোরো অঞ্চলের কাংগাবা, এবং দক্ষিণের সিকাসো অঞ্চলের ইয়ানফোলিলায়।
অ.ভি : আপনার মতে, মালিতে প্রকৃত অর্থনৈতিক ও সামাজিক সার্বভৌমত্বের নীতি কেমন হওয়া উচিত?
সিনামবান : প্রকৃত সার্বভৌমত্ব নির্ভর করে এমন এক উন্নয়ননীতির ওপর, যা মালির এবং সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের বাস্তব পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করে। এর জন্য প্রয়োজন জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণে গড়া গণতন্ত্র।
অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। বর্তমানে আমাদের দরকার সাম্রাজ্যবাদী ব্লকের বাইরে এক যৌথ শক্তি, যারা দক্ষিণের দেশগুলোকে সংগঠিত করবে—যাতে তারা প্রকৃত শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। আমি মনে করি এরিক তুসাঁ, আরনো জাকারি প্রমুখ চিন্তাবিদ এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ঘটিয়েছেন।
অ.ভি : সেনাবাহিনী ও তাদের মিত্রদের দ্বারা সংঘটিত নির্যাতন নিয়ে অনেক কথা হয়। ২০২২ সালের মোরার গণহত্যা এখনও সবার স্মৃতিতে তাজা। আজ আপনারা এই প্রশ্নটি কীভাবে মোকাবিলা করছেন?
সিনামবান : সত্যি বলতে সেনাবাহিনী সম্পর্কিত আলোচনায় শোভিনিজমই প্রাধান্য পাচ্ছে।
আমরা স্বীকার করি যে নির্যাতন হয়েছে, বিশেষত তথাকথিত রুশ প্রশিক্ষকদের আগমনের পর—যাদের আমরা যুদ্ধের ব্যবসায়ী বলি। এ বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা জরুরি, যাতে এসবের পুনরাবৃত্তি না হয়। এই ধরনের নির্যাতন ক্ষোভ তৈরি করে, যা সংগ্রামকে জটিল করে তোলে এবং জাতি-রাষ্ট্রের অখণ্ডতাকে হুমকির মুখে ফেলে।
অ.ভি: এই প্রসঙ্গে কি আপনি স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেন, নাকি প্রতিশোধের ভয় আছে?
সিনামবান : আমরা স্বাধীনভাবে এ নিয়ে কথা বলতে পারি না। এরই মধ্যে প্রতিশোধের ঘটনা ঘটেছে। গণতান্ত্রিক শাসনামলেও রাজনৈতিক নেতারা, যারা এসব প্রশ্ন নিয়মিত উত্থাপন করেছেন, নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে নির্বাসনে গেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আফ্রিকান সলিডারিটি ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইন্ডিপেনডেন্স (SADI)-এর সভাপতি ড. উমর মারিকোর কথা।
এমনকি সামাজিক আন্দোলনের ভেতরেও যারা নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলে, তাদের শত্রু মনে করা হয় এবং আন্দোলনের ভেতরেই প্রথমে তাদের দমন করা হয়।
অ.ভি : এই হিংস্রতা কি রাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে এবং জিহাদি নিয়োগকে সহজ করে দেয়?
সিনামবান : স্বাভাবিকভাবেই তাই হয়। আমি আগেই বলেছি, এই নির্যাতন ক্ষোভ তৈরি করে, যা অপরাধী জিহাদি কার্যকলাপকে উস্কে দেয়।
বাস্তবে, কিছু এলাকায় মানুষ আর রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করে না—বিভিন্ন কারণে। তারা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে নিপীড়নের শিকার হয়। যাদের আপনাকে রক্ষা করার কথা, তারাই নিপীড়ন চালায়, তখন আপনি কার কাছে যাবেন? আপনি তাদের দিকেই ঝুঁকবেন যারা তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দাবি তোলে। কৃষকেরা তাদের বংশানুক্রমিক উর্বর জমি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আদালতে তারা মামলা হারছে, আর সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো এই অবিচারের বিরুদ্ধে স্লোগান তোলে। এখানেই এই অপরাধী সংগঠনগুলো নিয়োগের সুযোগ খুঁজে পায়। রাষ্ট্রের উচিত নিরাপত্তা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা দেওয়া।
অ.ভি: নারী, তরুণ এবং বাস্তুচ্যুত মানুষরা এই যুদ্ধ ও সংকটের আবহে কীভাবে বেঁচে আছেন?
সিনামবান : পরিস্থিতি ভয়াবহ। আশ্রয়ের অভাব তীব্র, আর খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ এই বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর জন্য বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে।
অ.ভি : আপনি কি কোনো স্থানীয় উদ্যোগ দেখছেন—নারী, তরুণ বা সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে—যা ভিন্ন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়?
সিনামবান : হ্যাঁ, আছে। তবে নিরাপত্তাহীনতা গুরুতর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু এলাকায় সমবায় ও কৃষক সংগঠনগুলো এখনও অবস্থার ফারাক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। আগে যেসব এনজিও এসব উদ্যোগে সহায়তা করত, তারা এখন নিরাপত্তা সমস্যা বা অর্থাভাবের কারণে অনেক কম সক্রিয়।
অ.ভি : মরুকরণ ও খরার ফলে কৃষক ও পশুপালকেরা কীভাবে ভুগছে?
সিনামবান : ফলন ক্রমশ কম হচ্ছে, ফলে কৃষিকাজ করে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। বৃষ্টিপাত হয় খুব কম, আর অনেক সময় প্রবল বর্ষণে ফসল ভেসে যায়।
অন্যদিকে, পশুপালকদের গবাদিপশুর খাবারের অভাব তীব্র। উর্বর জমি দখল করতে গিয়ে বন ধ্বংস হচ্ছে, যার ফলে পশুর চারণভূমি নেই বললেই চলে। স্বাভাবিকভাবেই কৃষক ও পশুপালকের মধ্যে সংঘাত দেখা দেয়।
অ.ভি : গ্রামে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বর্তমানে কী আকার নিচ্ছে—খাদ্যসংকট, অভিবাসন, নাকি ত্রাণের ওপর নির্ভরতা?
সিনামবান : খাদ্যসংকট ও অভিবাসনই গ্রামে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার প্রধান কারণ। কর্মক্ষম মানুষদের জন্য একমাত্র বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশান্তর। সাহায্য কার্যত অনুপস্থিত, আর সামান্য যা আসে, তা প্রতীকী এবং অপমানজনকও।
অ.ভি : রাষ্ট্র কি আসলেই কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকে সমর্থন করছে, নাকি যুদ্ধই সবকিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে?
সিনামবান : যুদ্ধ হোক বা না হোক, খাদ্য উৎপাদনে রাষ্ট্রের কোনো অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যাপার নেই। বর্তমানে তুলো উৎপাদনের জন্য প্রচুর ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু খাদ্যশস্যের জন্য তেমন কিছু নেই। এটি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। সিস্টেম খাদ্য উৎপাদনে আগ্রহী নয়; এটি শিল্প-ফসলকেই প্রাধান্য দেয়। যুদ্ধের সঙ্গে কিন্তু এর সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।
অ.ভি : আপনি নিশ্চয়ই কিছু স্থানীয় উদ্যোগের কথা জানেন—যেমন সমবায়, ঐতিহ্যগত চর্চা, নারীদের উদ্যোগ। কিছু উদাহরণ দিতে পারেন?
সিনামবান : অবশ্যই, এমন উদ্যোগ আছে। আজও গ্রামের নারীরা একত্রিত হয়ে বর্ষাকালে একে অপরকে সাহায্য করছে—প্রতিদিন বিনা পারিশ্রমিকে পরস্পরের জমিতে কাজ করছে।
প্রায়ই দেখা যায়, কেউ সপ্তাহে একদিন অন্যের জন্য কাজ করে পারিশ্রমিক পায়, আর সেই অর্থ পরে তারা নিজেদের গড়া সংহতি তহবিলে জমা রাখে। তরুণরাও এতে অংশ নেয়, এবং এটি মালির বহু গ্রামে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমের বেলেদুগু অঞ্চলে এবং দেশের পূর্ব-পশ্চিম অংশে সাধারণ প্রথা।
কিছু অঞ্চলে এই সমবায়মূলক উদ্যোগ কেবল ফসল কাটার মরশুমে হয়, যাতে স্বল্প-শ্রমশক্তি সম্পন্ন পরিবারগুলোর ফসল নষ্ট না হয়।
অ.ভি : অনেকে মনে করেন মালি ও বুর্কিনা ফাসো একধরনের “নতুন আফ্রিকান স্বাধীনতা”র প্রতিনিধিত্ব করছে। আপনি কি মনে করেন এটি প্রকৃত স্বাধীনতা, নাকি কেবল ফরাসি প্রভাব থেকে রুশ প্রভাবের দিকে স্থানান্তর?
সিনামবান : আমার দৃষ্টিতে বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো প্রকৃত স্বাধীনতা নেই। আমরা দেখছি নতুন এক ধরনের বলকানাইজেশন, যেখানে এক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে অন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রতিস্থাপন করছে।
একজন মুক্তিকামী দাস, একের বদলে আরেক প্রভুকে বেছে নেয় না।
অ.ভি: সাহেল অঞ্চলের অন্যান্য দেশ—অথবা ভারতের মতো কোনো দেশ—এই অভিজ্ঞতা থেকে কী শিক্ষা নিতে পারে?
সিনামবান : আমি বলব, রাজনৈতিক সংগ্রাম সংগঠিত করার সময় অবশ্যই আদর্শিক বোঝাপড়া গড়ে তুলতে হবে। বড় কোনো প্রতিবাদী আন্দোলন যদি এমন মানুষের নেতৃত্বে হয় যাদের মধ্যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও শ্রেণিচেতনা অনুপস্থিত, তাহলে শেষ পর্যন্ত তারাই লাভবান হবে যারা শাসক শ্রেণির অংশ—এবং তারা কেবল দেশের সম্পদ নিয়ে দখলদারিত্বের জন্য লড়াই করবে, জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য নয়।
কোনো অস্থায়ী সরকার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলেই গণতন্ত্রবিরোধী মনোভাবকে সমর্থন করা উচিত নয়; কারণ অবিচারের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াইয়ের একমাত্র বিকল্প হলো গণতন্ত্র। বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোকে বুঝতে হবে যে, পশ্চিমা ব্লক হোক বা BRICS—কোনোটিই মুক্তি দিতে পারবে না; তারা কেবল একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকবে।
অ.ভি : ভারতে এবং অন্যত্র অনেক প্রগতিশীল কর্মী ইব্রাহিম ত্রাওরে ও মালির জুন্তার বক্তব্যের প্রশংসা করেন। আপনি তাদের কী বলতে চান—মালির মানুষের আসল অভিজ্ঞতা সম্পর্কে?
সিনামবান : গণআন্দোলন ও স্বাধীনতার পরিসর ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে। আমরা নানা ধরনের সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছি।
অ.ভি : আজ মালিয়ানদের জন্য কী ধরনের আন্তর্জাতিক সংহতি সত্যিকারের সহায়ক হতে পারে—এবং কোন ধরনের সহায়তা উল্টো কর্তৃত্ববাদকেই শক্তিশালী করবে?
সিনামবান : মালিয়ানদের প্রয়োজন শান্তি, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক স্বাধীনতার দাবিতে আন্তর্জাতিক সহায়তা। সহায়তার লক্ষ্য হওয়া উচিত পুঁজিবাদের প্রক্রিয়া ও তার সংঘাতগুলো ব্যাখ্যা করা। শুধু “ফ্রান্স” শব্দটিকে সামনে আনা নয়—কারণ তা স্থানীয় ব্যবসায়িক অভিজাতদের দ্বারা পরিচালিত শোষণকে আড়াল করে দেয়।