
[বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের অবসানের এক বছর হতে চলল। গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনের মুখ হিসাবে শুধুমাত্র ছাত্র-যুবদের কথা আমরা শুনলেও বহু সাধারণ শ্রমজীবি মানুষ এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। এই মুহুর্তে তাঁরা কেমন আছেন?
এদিকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প (Ready-Made Garments – RMG Industry) দেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস এবং বিপুল সংখ্যক শ্রমিক—বিশেষ করে নারীরা— এতে নিযুক্ত। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ (চীনের পর)। তাদের প্রধান রপ্তানি করা পণ্য হল টি-শার্ট, প্যান্ট, সোয়েটার, জ্যাকেট ইত্যাদি। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (বিশেষ করে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন), কানাডা ইত্যাদি দেশ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪% আসে পোশাক খাত থেকে।
এই শিল্পে কর্মরত ৪০ লাখ শ্রমিকের (যার মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি নারী) অবস্থা জানতে অলটারনেটিভ ভিউপয়েন্টের পক্ষ থেকে আমরা রেডিমেড গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন এর সভাপতি লাভলী ইয়াসমিনের সাথে কথা বলেছি । তিনি ১২ বছর বয়সে একজন শিশু শ্রমিক হিসাবে এই শিল্পে কাজ শুরু করেন। তাঁর কথায় উঠে এসেছে এই শিল্পের শ্রমিকদের বর্তমান অবস্থা, শিল্পের সঙ্কট ও শ্রমিক আন্দোলনের ভবিষ্যত।]
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে কর্মরত নারী গার্মেন্টস শ্রমিকদের অবস্থা কেমন?
লাভলী ইয়াসমিন – এই মুহূর্তে বাংলাদেশের নারী গার্মেন্টস শ্রমিকদের অবস্থা মিশ্র। কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে, আবার অনেক চ্যালেঞ্জও এখনো রয়ে গেছে। ইতিবাচক দিক হলো, তাঁরা এখন আগের চেয়ে বেশি সচেতন, কারিগরি দক্ষতা বাড়ছে, এবং অনেক নারী শ্রমিক এখন পরিবারে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তেও ভূমিকা রাখছেন। তবে বাস্তবতা হলো কর্মপরিবেশ এখনো অনেক কারখানায় মানসম্পন্ন নয়, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ও মাতৃত্বকালীন সুবিধা অনেকাংশে সীমিত। আরও বড় চ্যালেঞ্জ হলো চাকরির নিরাপত্তা, রপ্তানি কমে যাওয়ায় ছাঁটাইয়ের ঝুঁকি বেড়েছে, কাজের চাপ বেশি কিন্তু মজুরি তুলনামূলকভাবে কম। এছাড়াও যারা চাকুরী হারিয়েছেন তাদের মধ্যে গড়ে নারী শ্রমিকেরা সংখ্যায় বেশি এবং তাঁরা নিরুপায় হয়ে অর্ধেক মজুরিতে সাব কনট্রাক্ট কারখানায় কাজ করছেন। এমনিতেই শ্রমিকদের মজুরি যথেষ্ট নয়, তার মধ্যে তাঁরা আবার আগের তুলনায় বর্তমানে অর্ধেক মজুরিতে কাজ করছেন। তাহলে বোঝেন এই নারী শ্রমিকদের জীবনমান এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম চড়া, বিশেষ করে মাছ-মাংসের দাম। শুধু ডিম ডাল আর শাক পাতা খেয়ে, আন্তর্জাতিক বাজারের হাই-রেটেড ডলার মূল্যের মানসম্মত পোশাক তৈরি করে শরীর বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যায় না, এটা আমরা সবাই ভালো ভাবেই বুঝি।
পরিস্থিতি যেটাই হোক আর যেভাবেই বলি না কেন আমি একজন শ্রমিক নেত্রী হিসেবে মনে করি পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকদের অবস্থা কখনোই তেমন ভালো ছিল না, আমি একটু পিছনের দিকে যেতে চাই, সেই ৮০/৯০ দশকে কথা গ্রামের নদীভাঙ্গা, জমি-জমাহীন অসহায় দিনমজুর কৃষকের ঘরের বিশেষ করে নারীরাই গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে আসেন গার্মেন্টসের কাজের আশায়, এদের মধ্যে বেশির ভাগ ১৫ থেকে ২০ এর মধ্যে বয়স, আর কিছু সংখ্যক ডিভোর্স প্রাপ্ত ও বিধবা নারীরাও আছেন। এছারাও ঢাকা শহরে বেড়ে উঠা বিবাহিত ও অবিবাহিত দরিদ্র পরিবারের নারীরাও গার্মেন্টসের কাজে যোগদান করেন। এরা বেশিরভাগই অল্প লেখাপড়া জানা, আবার অনেকেরই লেখাপড়া ছিল না, এই ধরনের নারীরাই পোশাক শিল্পে কাজ করছেন দিনের পর দিন বছরের পর বছর। এছাড়াও ১৫ বছরের নিচে শিশু শ্রমিকের সংখ্যাও ছিল অনেক।
সকাল থেকে রাত ১০টা-১২টা এমনকি সারা রাত পর্যন্ত কাজ করতে হতো নারী শ্রমিকদের। প্রথমত মজুরি ছিলো কম, মেশিন হেল্পারদের বেতন ছিল ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আর অপরেটরদের বেতন ছিল ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা।
হাজিরা কাজ ছাড়া অন্য কোন কাজ ছিল না। কোন নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড কিছুই ছিল না, কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই, মিড-লেভেল ম্যানেজমেন্টের দুর্ব্যবহার, বেতন পরিশোধ না করেই মজুরিকর্তন, ওভারটাইমের ঘন্টা চুরি বা কর্তন, ছিল না কারখানায় কোন বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা।
বাসা-বাড়ির মতই ঘরের মধ্যে কয়েকটি মেশিন দিয়ে শুরু করতো গার্মেন্টস কারখানা, অনিরাপদ কর্ম পরিবেশের মধ্যে দিয়েই বাড়তে থাকলো কারখানার সংখ্যা একের পর এক। পরবর্তীতে বড় বড় বিল্ডিং তৈরি করলেও সেগুলো ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, বিল্ডিং কোড না মেনেই বানানো। ছিল না কোন ফায়ার এক্সিট অথবা আগুন লাগলে নেভানোর সে রকম কোন সরঞ্জামাদি। সে কারণেই ১৯৯০ সালে মিরপুর ১০ নাম্বারে সারাকা গার্মেন্টসে নামে একটি কারখানায় আগুন লেগে একজন মালিকসহ মোট ২৭ জন শ্রমিক আগুনে পুড়ে ও পায়ে দলিত হয়ে এবং ধোয়ার গন্ধে মারা যান। এটাই ছিলো শুরুর দিকের প্রথম ট্র্যাডেজি।
এছাড়াও গত ৪০ বছরে ছোট মাঝারি বড় ধরণের পোশাক কারখানায় আগুনে পুড়ে অথবা ভবন ধ্বসে/চাপায় পড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে অসংখ্য শ্রমিক। পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে আছেন হাজার হাজার শ্রমিক, পোশাক শিল্পের এই ট্রাজেডি যা কখনোই ভুলবার নয়।
এছারাও ৮০/৯০ দশকে তখনকার সময় রাত ১০-১১টার পর রাস্তায় মানুষের চলাচল ছিলো সীমিত , পরিবহনের সংখ্যাও কম এবং কম সংখ্যক দোকান-পাট ছিলো তাও আবার খোলা থাকত না। এমনকি রাস্তার লাইটের আলো থাকতো সীমিত।
ওরকম পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যেই নারী শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরতেন, তার ওপর বখাটেদের উৎপাত, কখনো কখনো ধর্ষণের মত ঘটনা সহ দেরি করে ঘরে ফেরায় পরিবারে ভুল বুঝাবুঝি সহ পারিবারিক জীবন হয়ে উঠতো দুর্বিষহ।
বাংলাদেশের পোশাক নারীরা শত নির্যাতন, অবহেলা,অবজ্ঞা, আর বঞ্চনার শিকার হয়েই এগিয়ে নিয়ে গেছেন এই শিল্পকে। আমরা কি কেউ মনে রেখেছি সেটা?
লাভলী ইয়াসমিন – আজ গোটা পৃথিবী জুড়েই পোশাক বাজার সৃষ্টিকারী এই নারী শ্রমিকদের হাতে তৈরী পোশাক পরেই পৃথিবীর বড় বড় মোড়লরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশ্বব্যাপী। গার্মেন্টসের নারী শ্রমিকদের এই জার্নিটা এত সহজ ছিল না।
পোশাক কারখানার মালিকরা একটি কারখানা থেকে গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রির মালিক হয়েছেন, দেশে বিদেশে তাদের সম্পদের অভাব নেই। একইভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায় শ্রমিকের শ্রম-ঘামেই হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তারা। অথচ বিদেশে “মেড ইন বাংলাদেশ” খ্যাত লেভেলের পোশাক সেলাই করা শ্রমিকের জীবনমান তেমন কিছুই বদলায়নি।
কোভিড ১৯ এর আগে বাংলাদেশে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এর রেজিস্টার্ড সদস্য পোশাক শিল্প কারখানার সংখ্যা ছিল সাড়ে চার হাজার (৪৫০০), শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫৫ লাখ, যার মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৭৫ থেকে ৮৫ ভাগ।
কোভিডের মধ্যে প্রায় ৮০০-১০০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যার মধ্যে বি এবং সি ক্যাটাগরি মাঝারি ও ছোট কারখানার সংখ্যাই ছিল বেশি। কোভিড পরবর্তী সময়ে কারখানার সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন হাজারের বেশি।
পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ – এর নির্বাচন হয়ে গেল ২০২৫ এর মে মাসে, তাদের ভাষ্যমতে বর্তমানে তাদের সদস্যভুক্ত গার্মেন্টস কারখানার সংখ্যা ১৮০৬ টি। তাদের ভোট গ্রহণেও ভোটার সংখ্যা তাই ছিলো। এ সকল কারখানার মোট শ্রমিকের সংখ্যা ২৭ লাখ।
এ ছাড়াও সাব কন্ট্রাক্ট এর কারখানা রয়েছে প্রায় দুই হাজারের মতো, শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ।
গত ২০২৪ এর জুলাই আন্দোলনে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বহু সংখ্যক আওয়ামীপন্থী গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা কারখানা ফেলে দেশের বাইরে ও দেশের ভেতরে আত্মগোপনে আছেন। তাদের কারখানাগুলো গত একবছরে ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে গেছে একের পর এক। আর এসব কারখানার শ্রমিকরা তাঁদের ন্যায্য আইনগত পাওনাদি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। গত ২০/২৫ বছরের কর্মরত শ্রমিকরা তাদের সার্ভিস বেনিফিট সহ অন্যান্য পাওনাদি না পেয়ে নাম মাত্র বেতন নিয়ে ঘরে ফিরেছেন। হাতে গোনা কয়েকটি কারখানার দায়িত্ব নিয়ে বেতন সহ নামমাত্র বেনিফিট প্রদান করেন অন্তবর্তীকালীন সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়। শ্রমিক সহ শ্রমিক সংগঠনগুলো এক প্রকার বাধ্য হয়েই মেনে নিয়েছিল ওরকম পরিস্থিতির, যা বিগত দিনে এক ব্যতিক্রম।
পরিসংখ্যান বলছে কোভিডের পর বিজিএমইএ এর রেজিস্টার্ড সদস্য ভুক্ত ৪৫০০ কারখানা থেকে ১৮০৬ টি তে এসো পৌছালো কারখানার সংখ্যা, তার মধ্যে গ্রীন কারখানা রয়েছে ২৪৮টি।
এদিকে বন্ধ হওয়া কারখানার শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। বর্তমানে বেকারত্বে ভুগছেন শ্রমিকরা, বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা। শ্রমিক সংগঠনগুলোর জরিপে ও এনজিও প্রতিষ্ঠান কর্মজীবী নারীর সেমিনারের আলোচনায় নারী শ্রমিকরা উপস্থিত হয়ে জানিয়েছেন যে বিগত দিনে বন্ধ হওয়া গ্রুপ কারখানায় মেশিন অপারেটর হিসাবে ১৭ হাজার টাকা বেতনে কাজ করলেও বর্তমানে নিরুপায় হয়ে সাব কন্ট্রাক্ট কারখানায় ৯/১০ হাজার টাকা মজুরিতে কাজ করছেন তাঁরা। এছাড়াও মেশিন হেলপার পদে শ্রমিকরা বেতন পান ৫/৭ হাজার টাকা যা কিনা শ্রম আইনের পরিপন্থী। অথচ একই পদে গ্রুপ কারখানাগুলোতে শ্রম আইন অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরি হেলপার পদে পাচ্ছেন ১২৫০০ টাকা।
আপনি যে সাব কন্ট্রাক্ট কোম্পানির কথা বললেন তাদের সংখ্যা কত এবং সেখানে কী পরিমাণ শ্রমিক কাজ করছেন ও কাজের পরিবেশ কেমন ?
লাভলী ইয়াসমিন – বিজিএমই এর সদস্য ভুক্ত না এমনকি কলকারখানার অনুমোদন প্রাপ্ত না অর্থাৎ ট্রেড লাইসেন্স বিহীন কারখানার সংখ্যা রয়েছে প্রায় ২০০০ এর মত। এসব কারখানার মালিকরা বড় বড় গ্রুপ ফ্যাক্টরি থেকে বায়ার ব্রান্ডের কাজ নিয়ে আসে, কাজ করেন সাব কন্ট্রাক্টর হিসাবে। এসব সাব কন্ট্রাক্ট কারখানার শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ১০ লাখের বেশি।
এসব সাব কন্ট্রাক্ট কারখানার মালিকরা শ্রম আইনের ধার ধারেন না, নিজেদের ইচ্ছা মতোই কাজ করান শ্রমিকদের। যার মধ্যে রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ বিল্ডিং, অনিরাপদ কর্ম পরিবেশ, মজুরি কম, আইন অনুযায়ী ওভার টাইমের মজুরি প্রদান না করা, সঠিক সময়ে মাসিক বেতন প্রদান না করা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ছুটির কোন নিয়ম নীতি না থাকা, বেআইনি ভাবে শ্রমিক ছাঁটাই, নোটিশ ছাড়াই যখন তখন কারখানা বন্ধ নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ।
আর এসব দেখেও না দেখার ভান করেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এর কর্তৃপক্ষ বলেন এরা আমাদের রেজিস্টার্ড সদস্য না, কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপপ্রধান পরিদর্শক বলেন এরা আমাদের অনুমোদন প্রাপ্ত না, আর ব্রান্ড-বায়াররা তো জানেই না তাদের অর্ডারগুলো সেলাই করা হচ্ছে এসব ফ্যাক্টরিগুলোতে।
তাহলে এসব কারখানার দায় কাদের? কোথা থেকে পায় এত সাহস আইনকে তোয়াক্কা না করে দিনের পর দিন শ্রমিক ঠকিয়ে বেআইনি ভাবে কাজ করানোর!
আপনি শ্রমিকদের মাইগ্রেশন এর কথা বললেন তা কি শুধু মহিলা শ্রমিকদের ক্ষেত্রেই না পুরুষ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি একইভাবে সত্যি?
লাভলী ইয়াসমিন – এই ক্ষেত্রে নারী পুরুষ উভয়ে চাকুরীচ্যুত হয়েছেন, গত এক বছরে বাংলাদেশে ১৫৫টিরও বেশি পোশাক, নিট ও টেক্সটাইল কারখানা বন্ধ হয়েছে, এর মধ্যে বিজিএমইএ -র সদস্য ৭৬টি রেডিমেড গার্মেন্ট কারখানা, বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) র সদস্য ৫০টির বেশী এবং বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) র সদস্য ১৪টি কারখানা।
এছাড়াও গত এক বছরে সোয়েটার খাতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ দেখা গেছে। সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো Natural Wool Wears Limited সোয়েটার কারখানাটি বন্ধ হয়ে যাওয়া, যেখানে প্রায় ৯০০ শ্রমিক হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
সব মিলিয়ে সোয়েটার খাতেও একটি অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব শ্রমিকদের জীবনে সরাসরি পড়ছে। তবে সোয়েটার কারখানায় পুরুষ শ্রমিক সংখ্যায় বেশি এবং পিস রেটে কাজ করে, যে যত কাজ করবেন সে তত টাকা পাবেন, একেক জন মাসে পিস রেটে কাজ করেন বেতন তোলেন ২৫ থেকে ত্রিশ হাজার টাকা।
যে সকল সোয়েটার কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে সেখানকার পুরুষ শ্রমিকরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। চাকরিচ্যুত সোয়েটার কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে অনেককেই ওভেন কারখানায় কাজ নিতে হয়েছে, প্রথমত সেখানে তাদের কাজ শিখতে হয়েছে এবং বেতনভুক্ত মজুরিতে কাজ নিতে হয়েছে। কিন্ত বেশিরভাগ শ্রমিক ওভেন কারখানায় টিকে থাকতে পারেননি মজুরি কমের কারণে। ফলে তারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে অটোরিকশা থেকে শুরু করে একাধিক দৈনিক মজুরি কাজের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। গত কয়েক বছরে ঢাকা শহরে শ্রমিকদের বেকারত্বের কারণে অটোরিকশা, স্ট্রিট ভেন্ডার, ছোট ছোট খাবারের দোকান এক ধাক্কায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এবং কারখানা বন্ধ হওয়ার ফলে তারা নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে এই কাজগুলি বেছে নিয়েছেন। এরকম অনেকের কাছে এই ছোট ব্যবসা শুরু করার মতও মূলধন পর্যন্ত নেই। তাঁরা গ্রামে গিয়ে নিজেদের জমি বিক্রি করে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে অনেকেই অবৈধ পথে বিদেশে যেতে গিয়ে পথের মধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন, আবার অনেকে ঝুঁকি নিয়ে পৌঁছে কাজও করছেন। এর মধ্যে অনেক নারী শ্রমিকও বৈধ পথে মধ্যপ্রাচ্যের বাসা বাড়িতে গৃহ শ্রমিকের কাজে গেছেন।
পোশাক শিল্পে কর্মরত নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে কাজের মান বা মজুরি নিয়ে কি কোনরকম বৈষম্য আপনারা দেখেছেন?
লাভলী ইয়াসমিন – হ্যাঁ, মিডলেভেল ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়, এখানে উচ্চ পদে পুরুষদের সংখ্যাই বেশি, কিছু পদের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ কর্মচারীদের মধ্যে মজুরি বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়, একই ধরনের কাজে পুরুষ কর্মচারীরা মজুরি পান বেশি এমন কি দ্রুত পদোন্নতিও হয়, যেখানে নারীরা পিছিয়ে আছেন। তবে সুইং মেশিন অপারেটরের ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা বেশি এবং নারীরাই দক্ষ এবং কোয়ালিটি সম্পূর্ণ কাজ করেন, এখানে কোন মজুরি বৈষম্য নেই, এমনকি মূল ন্যূনতম মজুরি কাঠামোতেও কোন বৈষম্য নেই, কিন্তু বাস্তবে পদ, সুযোগ, ও প্রণোদনার ক্ষেত্রে এই ব্যবধান এখনো বিদ্যমান।
ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব হিসেবে আমরা চাই লিঙ্গ পরিচিতি হিসাবে নয়, যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে সমান মজুরি ও সুযোগ নিশ্চিত করা হোক।
এদিকে আসছে আবার শ্রমিকের উপর মড়ার ঘা “আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের পোশাকর রপ্তানিতে ৩৫% শুল্ক আরোপ”। ৩৫% শুল্কসমেত যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি করা বাংলাদেশের জন্য একটি ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ। এই শুল্কের কারণে আমাদের পণ্যের দাম প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বেশি পড়বে, ফলে অনেক বায়ার আমাদের বাদ দিয়ে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। এতে রপ্তানি কমে যাচ্ছে, অর্ডার হারাচ্ছে কারখানাগুলো। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে আমাদের শ্রমিকদের ওপর। অনেকেই কাজ হারাচ্ছে, অনেকে ঠিকমতো বেতন পাচ্ছে না।
একজন ট্রেড ইউনিয়ন নেত্রী হিসেবে আমি মনে করি এই শুল্ক যুদ্ধ শুধু একটি বাণিজ্য সমস্যা নয় এটি একটি মানবিক ও সামাজিক সংকট। আমাদের দেশের পোশাক খাত নারী শ্রমিক নির্ভর, আর এই শুল্ক তাদের জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তাই এখন প্রয়োজন সরকারের কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ, বায়ারদের আস্থা অর্জন, এবং শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিতে বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের জন্য মর্যাদা সম্পন্ন মজুরি ও কাজের পরিবেশ, বেতন বৈষম্য নিরসন এবং শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার জন্য জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে করে আমরা এই বৈষম্যমূলক শুল্কের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারি।
বর্তমান সরকারের ভুমিকা সম্বন্ধে কী বলবেন?
লাভলী ইয়াসমিন – ৫২ বছর পর এই প্রথম বাংলাদেশে অন্তবর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন, এর মধ্যে (১) শ্রম সংস্কার কমিশন, (২) নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন, (৩) স্থানীয় সরকার কমিশন রয়েছে। এই তিনটি কমিশনেই গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য।
বর্তমানে যে শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে তার চেয়ারম্যান হিসেবে সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহাম্মেদ ভাই দায়িত্ব গ্রহণ করায় আমরা শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ খুব খুশি হয়েছি। কারণ তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিধিমালা ও শ্রম আইন নিয়ে সংস্কার ও গবেষণামূলক কাজ করেছেন। এবং তিনি নিজেও একজন ট্রেড ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। ফলে প্রাথমিকভাবে তার প্রতি আমাদের যথেষ্ট ভরসা এবং আশা আছে। ইতিমধ্যেই তিনি আমাদের সাথে অর্থাৎ সকল শ্রমিক ফেডারেশনের প্রতিনিধিদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। এবং আমাদের দাবিগুলোকে লিখিত ভাবে পেশ করতে বলেছেন। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের আইনের স্বীকৃতি সহ শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী শ্রম আইনগুলোর সংস্কার চেয়ে লিখিত পত্র পেশ করেছি শ্রম কমিশনের নিকট। আমরা আশা করছি যদি সরকার কমিটেড থাকে দেশের মানুষের প্রতি ভালো কিছু করার, তাহলেই সম্ভব হবে শ্রম আইন সংস্কারের মধ্যে দিয়ে শ্রমিকের ভাগ্যের পরিবর্তন আনার।
গত ২০২৪ এর জুলাই আন্দোলনে পরবর্তী ৫ই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে বহু সংখ্যক আওয়ামী-লীগপন্থী গার্মেন্টস ব্যবসায়ী কারখানা ফেলে দেশের বাইরে ও দেশের ভেতরে আত্মগোপন করে আছেন। এমত অবস্থায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর যে হত্যা মামলা দেওয়া হয়েছে সেই একই মামলা দেওয়া হয়েছে একজন চায়ের দোকানদারের উপরে। বিভিন্ন পোশাক কারখানার মালিকের উপর হত্যাসহ একাধিক মামলা দেয়া হয়েছে। এর ফলে মালিকরা দেশের বাইরে বা ভেতরে আত্মগোপন করে আছেন। আমরা যারা ট্রেড ইউনিয়ন করি তাদেরকে সরকারের সাথেই কাজ করতে হয় শ্রমিকের সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্য। গত ১৬/১৭ বছর ধরে হাসিনা সরকারের দাখিন্য নিয়ে থাকা শিল্পপতিরা কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বর্তমানে মামলার ভয়ে আত্মগোপন করে আছেন।
এতে তাদের অসুবিধা না হলেও শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছেন। এর ফলে শ্রমিকরা নিজেদের দাবি দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নামলে তাদের ফ্যাসিবাদের দোসর বলে ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়। যেমন ব্যক্তিগতভাবে আমি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছিলাম না এবং আমাদের শ্রমিক ফেডারেশন স্বাধীনভাবেই শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে কাজ করেছে। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে কিছু সংখ্যক ফেডারেশনের নেতাকর্মীরা যারা নিজেদেরকে দাবি করেন বর্তমান সরকারের লোক হিসেবে, তারা আমাদেরকে একাধিক ভাবে আক্রমণ করেছে এবং ফ্যাসিবাদের দোসর বলে ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। এই সময়কালীন শ্রম মন্ত্রণালয়ের আন্ডারে শ্রমিক নেতাদের নিয়ে কয়েক ধরনের কমিটি গঠন করা হয়েছে, যেখানে আমাদেরকে রাখা হয়নি। অথচ আমরাই মাঠ থেকে শুরু করে পলিসি মেকিং পর্যায়ে সুনামের সাথে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সংগ্রাম করে আসছি বছরের পর বছর। এই সেক্টরে আমাদের অবদান ও অর্জন কোন অংশে কম নয়।
আমাদের শ্রমিক সংগঠনের মূল সম্পদই হচ্ছে আমাদের শ্রমিকরা। ইউনিয়নের সদস্য, সাধারণ সদস্য এবং সংহতি সদস্য শ্রমিকরা আমাদের অফিস ভাড়া থেকে শুরু করে সংগঠন চালানোর সমস্ত খরচ শ্রমিকরাই বহন করেন চাঁদা ও অনুদানের মাধ্যমে। এছাড়াও দেশীয় কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী সংগঠনকে সহযোগিতা করেন বিভিন্ন সময়ে। সরকারে যেই থাকুক না কেন আমাদের তাদের সাথে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের মাধ্যমেই শ্রমিকদের সমস্যার সমাধান করতে হয়। যেমন বর্তমান সরকারের সাথেও বেশ কয়েকটি কারখানার সমস্যা নিয়ে আলোচনা সাপেক্ষে সমস্যা সমাধান করি। মালিকদের সম্পত্তি সরকারের হেফাজতে রেখে সরকারই পারে সরকারি তহবিল থেকে শ্রমিকদের টাকা প্রদান করতে। ফলে ভিত্তিহীনভাবে ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে ট্যাগ লাগিয়ে দিয়ে আমাদের মত ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের আতঙ্কিত করে তুললে ক্ষতি শ্রমিকদেরই হবে।
যদিও একাধিক সংঘর্ষের পরে বর্তমানে সরকার বুঝেছে যে যারা শ্রমিক আন্দোলন করে তাদের দলমত নির্বিশেষে বিরাজমান সরকারের সাথেই কাজ করতে হয়। আমাদের লক্ষ্য শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। ফলে দলের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে গিয়েই আমাদের শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের উদ্দেশ্যের লড়াই সংঘটিত করতে হবে।
আপনার কথা থেকে এটা পরিষ্কার যে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শ্রমিকদের সমস্যার প্রশ্নে কিছুটা আন্তরিক এবং সেই জন্যই তারা বিভিন্ন কমিশন গঠন করেছেন কিন্তু নির্বাচিত সরকার না হওয়ার ফলে তাদের পক্ষে কি কোনভাবেই শ্রমিকদের পক্ষে নতুন আইন প্রণয়ন করা সম্ভব? শ্রমিকদের পক্ষে নতুন আইন নিয়ে আসলে সম্ভাবনা থাকে বড়লোকেদের চাপে সেই সরকারের ভেঙে পড়ার। নির্বাচিত না হওয়ার ফলে এই সরকারের বাস্তব জনভিত্তি কি তা নিয়ে সংশয় দেখা দিচ্ছে। এ নিয়ে আপনার মতামত কি?
লাভলী ইয়াসমিন – এক্ষেত্রে একটি কথা মাথায় রাখতে হবে বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোন দল দ্বারা প্রভাবিত নয়। এর আগের নির্বাচিত সরকারগুলির সাথে একাধিক ব্যবসায়ীরা দলের কমিটির সাথে যুক্ত থেকে এমপি, মন্ত্রী, সিটি মেয়র হয়েছেন। ফলে শ্রমিকবান্ধব কোন আইন পাস করাতে গেলে ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে পড়তে হতো সরকারকে, কিন্তু বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু স্বাধীন তাই তারা চাইলেই পোশাক শিল্পের সাথে যুক্ত শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের আইনি জটিলতা ও সমস্যাগুলির সমাধান করতেই পারেন।
আমরা শ্রমিক সংগঠনগুলো আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর কনভেনশন অনুমোদন ও বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছি। যার ফলশ্রুতিতে বর্তমান সরকার আইএলও কনভেনশন যেমন সি১৫৫, সি১৮৭, সি১৯০ অনুমোদন করবে বলে যথেষ্ট উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।
শ্রম আইন অনুযায়ী একটি কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করতে হলে বিশ শতাংশ সদস্য ফর্ম (ডি ফর্ম /(৫৫)ক) ফিলাপ করতে হয়। গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রির একেকটি কারখানায় বহু সংখ্যক শ্রমিক হওয়ায় ইউনিয়নের জন্য বিশ শতাংশ ফর্ম ফিলাপ করা কঠিন ও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা শ্রম কমিশনকে সুপারিশ করেছি এই পার্সেন্টেজের সংখ্যা তুলে দেওয়ার জন্য। ইউনিয়ন গঠনের সহজিকরণ ও তা অবাধ করা।
পোশাকশিল্পে নিযুক্ত নারী শ্রমিকরা মাতৃত্বকালীন ছুটি পান মাত্র চার মাস যেখানে অন্যান্য ক্ষেত্রে নিযুক্ত এবং সরকারি কর্মচারীরা ছুটি পান ছয় মাস। আমাদের দাবি দেওয়ার মধ্যেও স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, একদেশে একই ক্ষেত্রে দুই আইন থাকতে পারে না। পোশাকশিল্পে নিযুক্ত নারী শ্রমিকদেরও মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস দিতে হবে।
এই বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সাথে সহমত পোষণ করেছেন। তবে এক্ষেত্রে অনেক কিছুই নির্ভর করছে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপর। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শ্রম কমিশনের সুপারিশগুলোকে গেজেট আকারে পাশ করলেও পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকারকে পার্লামেন্টে সংসদে সদস্যদের ভোট গ্রহণের মাধ্যমে আইন হিসেবে পাস করাতে হবে। পরবর্তী ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হওয়ার কথা আছে। সরকারের কাছে যথেষ্ট সময় আছে গেজেট পাশ করানোর জন্য। ফলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে থেকেই গেজেটকে আইনে রূপান্তর করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে অথবা শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী কোনরকম পরিবর্তন করতে গেলে শ্রমিক সংগঠনগুলোর শক্তিশালী আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হবে সরকারকে।
আপনাকে এই সমস্ত কথাগুলি তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ। আপনার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু বলার যদি থাকে তা আপনি বলতে পারেন। অথবা আপনি যদি পাঠকের কাছে কোন বার্তা দিতে চান তা নির্দ্বিধায় দিতে পারেন।
লাভলী ইয়াসমিন – আমি নিজে মাত্র ১২ বছর বয়সে একজন শিশু শ্রমিক হিসেবে হেলপার পদে কাজ শুরু করি। পরবর্তীতে দক্ষ অপারেটর, সুপারভাইজার ও লাইন চিফ পদে প্রায় ১০ বছর কারখানার ভেতরে থেকে কাজ করেছি। ফলে শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে।
১৭ বছর বয়সে মিরপুর দশ নম্বরে স্প্যারো অ্যাপারেল লিঃ নামে একটি কারখানায় কারখানায় কাজ করা কালীন আমি সহ আমার সহযোদ্ধারা শ্রমিকদেরকে সংগঠিত করে ইউনিয়ন গঠন করি ও রেজিস্ট্রেশন পাই। আমি ছিলাম ইউনিয়নের কমিটির জয়েন্ট সেক্রেটারি। আমরা শ্রমিকদের পক্ষ থেকে চার্টার অফ ডিমান্ড দাখিল করলে, ডঃ মাজারুল ইসলামের ছেলে চয়ন ইসলাম তাৎক্ষণিক ভাবে আমাদের এলাকার ভাড়া করে মাস্তান দিয়ে পিস্তল হাতে ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক সকল নেতৃবৃন্দকে একসাথে বের করে দেয়। পরের দিন কারখানার সকল শ্রমিক রাস্তায় আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা, আমাদের বিরুদ্ধে মামলা, মিছিলে দফায় দফায় হামলা এবং এর প্রতিবাদে আমরাও পাল্টা মামলা দিয়েছিলাম। এভাবেই ছয় মাস ধরে আন্দোলন চলেছিল। এছাড়াও আমি সহ ৩৫ জন কমিটির নেতৃবৃন্দ ও ইউনিয়নের সদস্যরা চাকরি ফেরতের মামলা দায়ের করেন শ্রম আদালতে। এবং জজ কোর্টে আমি নিজে বাদি হয়ে ক্রিমিনাল অফেন্সের মামলা চালিয়েছি দীর্ঘদিন।
এরপরেও বিভিন্ন সময়ে শ্রম অসন্তোষের ফলে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বহু হামলা, মামলার শিকার হয়েছি একের পর এক। ২০০৮ সালে আমার মেয়েটা তখন দশ বছরের, তাকে রেখেই ঘর ছেড়ে পালিয়ে থেকেছি মাসের পর মাস। আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিয়ে বছর খানেকের মধ্যে বেকসুর খালাস পেয়েছি সব মামলা থেকে।
কথাগুলো এজন্যই বললাম, আমরা যারা নেতৃত্ব দেই তারা জেল-জুলুম মাথায় নিয়েই নেতৃত্ব দিই। এক কথায় বলতে পারি আমার এই দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের জার্নিটা সহজ তো ছিলোই না, বরং কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছিল।
গত এক বছরের টালমাটাল অবস্থার ফলে আমরা ইম্পোর্টারদের আস্থা হারিয়েছি এবং এর ফলে বিপুল সংখ্যক কারখানা বন্ধ হয়েছে তাতে শ্রমিকদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়েছে। বিশ্ববাজারে কিছুদিন আগে অবধিও বাংলাদেশের শ্রমিকরা তাদের দক্ষতার জন্য বিখ্যাত ছিল। আজকে দক্ষ শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। আজকের সময় দাঁড়িয়ে আমাদের সামনে শ্রমিকদের সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা নিশ্চিত নই যে অবস্থা আদতেই পূর্বের অবস্থার মত হবে কিনা।
পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের এই সমস্যার সময়ে কি বাংলাদেশের অন্যান্য ক্ষেত্রের শ্রমিকরা ও সাধারণ মানুষ পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন?
লাভলী ইয়াসমিন – একদমই। বাংলাদেশে মোট শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা সাত কোটি সাত লাখ। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিপুল সংখ্যক মানুষ পোশাক শিল্পের সাথে নির্ভরশীল, একটার সাথে আরেকটা ওতপ্রুত ভাবে যুক্ত, তাই খারাপ সময়গুলো একে অপরের পাশেই থাকেন। এমনকি পূর্বে গার্মেন্টস শ্রমিকদের একরকম অবজ্ঞার চোখে দেখা হলেও এখন এই পোশাক শ্রমিকরা সম্পূর্ণভাবে স্বীকৃত এবং আমাদের অর্থনীতিতে কত বড় ভূমিকা রাখে এটা সম্পূর্ণ দেশের মানুষ জানে এবং এই পেশাটিকে খুবই সম্মানের সাথে দেখে তাই সাধারণ থেকে সব খাতের কর্মজীবী মানুষেরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের যে কোন ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের পক্ষে তাদের পাশেই থাকেন।