চিলি আজ এমন এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে উপনীত, যেখানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কেবল ক্ষমতার পালাবদলের লড়াই নয়—এটি ভবিষ্যতের সামাজিক প্রকল্প ও রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যকার মৌলিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন। সদ্যসমাপ্ত প্রথম রাউন্ডে কমিউনিস্ট প্রার্থী জেনেথ জারা সর্বোচ্চ ২৬.৮৫ শতাংশ ভোট সংগ্রহ করে শীর্ষে অবস্থান করেছেন। তাঁর পিছনে রয়েছেন উগ্র দক্ষিণপন্থী নেতা হোসে আন্তোনিও কাস্ত, যাঁর ভোটহার প্রায় ২৩.৯২ শতাংশ। এখন ১৪ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত পর্বে এই দুই বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক আদর্শ মুখোমুখি দাঁড়াতে চলেছে।
এর মধ্যেই রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে নিরাপত্তা, অভিবাসন ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা—যা লাতিন আমেরিকার বহু রাষ্ট্রে বিগত এক দশকে জনমত নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে।
নিরাপত্তা ও অভিবাসন: আতঙ্কের রাজনীতির উত্থান
চিলি ঐতিহ্যগতভাবে লাতিন আমেরিকার অপেক্ষাকৃত নিরাপদ দেশ হিসেবেই পরিচিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে গ্যাঙ-সংক্রান্ত অপরাধ, বিশেষত ভেনেজুয়েলার Tren de Aragua সংগঠনের সক্রিয়তার অভিযোগ, নাগরিকদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। অপহরণ, চাঁদাবাজি, দুষ্কৃতিমূলক হত্যাকাণ্ড—এ ধরনের ঘটনাই মানুষের দৈনন্দিন চিন্তায় প্রাধান্য পেয়েছে।
এই ভয়ের আবহেই কাস্ত তাঁর প্রচারের ভিত রচনা করেছেন। কঠোর অভিবাসন নীতি, সীমান্তে প্রাচীরসদৃশ অবকাঠামো নির্মাণ, অবৈধ অভিবাসীদের তাৎক্ষণিক বহিষ্কারের মতো প্রতিশ্রুতি তাঁর শিবিরকে সমর্থন জোগাচ্ছে। রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা পুনরুদ্ধারের নামে তিনি দৃঢ় আইনশৃঙ্খলার একটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকাঠামোর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।
অন্যদিকে জারা নিরাপত্তা-প্রশ্নকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। নতুন কারাগার নির্মাণ, অপরাধ-দমন বাহিনীর আধুনিকীকরণ—এসবের পাশাপাশি তিনি জোর দিচ্ছেন সমাজমুখী নীতিতে: স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ, যুবসমাজকে সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনা, রাষ্ট্রের সামাজিক দায়িত্বের বিস্তার। তাঁর যুক্তি, অপরাধ দমনে কেবল কঠোরতার উপর নির্ভর করলে স্থায়ী ফল আসবে না, বরং সমাজের ভিতরে বৈষম্যের মূলে আঘাত করতেই হবে।
অভিবাসন প্রসঙ্গও নির্বাচনী আলোচনায় বিপুল গুরুত্ব লাভ করেছে। ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে পালিয়ে আসা অভিবাসীদের নিয়ে দেশে প্রবল বিতর্ক চলছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, দেশের অপরাধ-চিত্র সম্পূর্ণভাবে অভিবাসন-নির্ভর নয়, দক্ষিণপন্থী প্রচার এই আতঙ্ককে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় উসকে দিয়েছে।
অর্থনীতি ও ভোটার মানসিকতা: কোন পথে প্রবাহিত জনমত?
অর্থনৈতিক সংকটও নির্বাচনী মনোভাব গঠনে বড় ভূমিকা রাখছে। মুদ্রাস্ফীতি, আয়-হ্রাস, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা—এসব মিলেই এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা রাজনৈতিক বার্তায় সহজেই স্থান করে নিচ্ছে।জারা এখানে তুলে ধরছেন প্রগতিশীল কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণা—সুলভ বাসস্থান, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা, কর্মসংস্থানের প্রসার। তাঁর মতে, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপই অর্থনৈতিক বৈষম্যের ঘাটতি পূরণ করতে পারে।
কাস্তের জবাব: রাজস্বকাঠামো সংকুচিত করে ব্যক্তিপ্রণোদিত অর্থনীতি গঠন। কর হ্রাস, বিনিয়োগবান্ধব নীতি এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা সীমিত করার প্রতিশ্রুতি মধ্যবিত্তের একাংশকে তাঁর পক্ষে টেনে আনছে।এবার নির্বাচনে বাধ্যতামূলক ভোট প্রয়োগ হওয়ায় বহু নতুন ভোটার প্রথমবার ব্যালটবাক্সের সামনে হাজির হয়েছেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত শেষপর্যন্ত কোন প্রান্তকে শক্তিশালী করবে—এ প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা।
সম্ভাব্য ফলাফল: কোন দিকে গড়াবে চিলির ভবিষ্যৎ
প্রথম রাউন্ডের ফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে—ডানপন্থী ভোটসমূহ দ্রুত কাস্তের দিকে সরে আসছে। জোহানেস কায়সার ও এভলিন মাথেই ইতিমধ্যে তাঁকে সমর্থন জানিয়েছেন। ফলে দ্বিতীয় পর্বে কাস্তের অবস্থান আরও দৃঢ় হতে পারে।কাস্ত যদি জেতেন, চিলি প্রবেশ করতে পারে এক কঠোর আইনশৃঙ্খলা-নির্ভর রাষ্ট্রব্যবস্থায়, যেখানে অভিবাসন ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রাধান্য পাবে। বিপরীতে, জারা জিতলে সামাজিক সুরক্ষা ও জনকল্যাণভিত্তিক নীতির বিস্তার তাঁর মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে—সংসদের ভারসাম্য, করব্যবস্থার সংস্কার, এবং সমাজের বিভাজন কমানোই হবে তাঁর প্রধান কাজ।
উপসংহার: দ্বিধাবিভক্ত এক রাষ্ট্রের নির্বাচন
চিলির এই নির্বাচন মূলত দুই ভিন্ন রাজনৈতিক প্রকল্পের লড়াই। একদিকে আতঙ্ক ফেরি করার রাজনীতি, কঠোর রাষ্ট্রশাসন ও অভিবাসনবিরোধী আগ্রাসী নীতি; অন্যদিকে সামাজিক ন্যায়, সমতা ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধের বিস্তারের প্রতিশ্রুতি।বর্তমান লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক পরিবেশে এই নির্বাচন এক গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হয়ে উঠতে পারে। চিলির ভবিষ্যৎ কোন পথে মোড় নেবে—তা নির্ভর করছে আগামী ১৪ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফলের ওপর। এই নির্বাচন শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেই নয়, অঞ্চলের বৃহত্তর ভূরাজনীতিকেও প্রভাবিত করবে।চিলির ভোটাররা তাই একধরনের দ্বিধাবিভক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে —যেখানে প্রশ্ন একটাই: নিরাপত্তার কঠোর ছায়ায় আবদ্ধ রাষ্ট্র, নাকি ন্যায়ভিত্তিক সমাজমুখী চিলি—কোনটিকে তারা নতুন ভবিষ্যতের রূপরেখা হিসেবে গ্রহণ করবেন?
