
২০২২ সাল থেকে শ্রীলঙ্কা থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনের হাওয়া বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে কোটা বিরোধী আন্দোলনে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লে হাসিনা সরকার আন্দোলনকারীদের উপর সন্ত্রাস নামিয়ে আনে। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে সরকারের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক আন্দোলনের ডাক দিলে সমস্ত ধরনের চেষ্টার পড়েও জনগণের আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। বর্তমানে এই আন্দোলনের জোয়ার আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপালে এসে পৌঁছেছে। রাজনৈতিক ভাবে বাম-ডান উভয় পক্ষই বিভিন্ন তত্ত্ব আমাদের সামনে নিয়ে আসতে শুরু করেছে। তবে বাম-ডান দু-পক্ষই নেপালে গণ-আন্দোলনের সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার ভূত দেখছে। বর্তমান সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার কোনো প্রকাশ্য প্রমাণ যেমন নেই ঠিক তেমনই অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব একদমই যে নেই তা বলার সময়ও এখনও আসেনি। কিন্তু এ কথা দায়িত্ব নিয়ে বলা যায় যে নেপালে শুধুমাত্র সাম্রজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রে এই আন্দোলন হচ্ছে না, বরং শেষ প্রায় ২০ বছর ধরে নেপালি মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার মধ্যে দিয়ে যে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বৃদ্ধি পুঞ্জীভূত হচ্ছিল সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করায় সেই বারুদ ফুলকির কাজ করে। আমরা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যেমন দেখেছিলাম কোটা আন্দোলন ছিল জনগণের বিরুদ্ধতার লক্ষণ; ঠিক তেমনই নেপালে সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করার মতো অগণতান্ত্রিক নিয়ম জনবিরোধী সরকারের কফিনে সম্ভবত শেষ পেরেক।
যুগ যুগ ধরে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পর ২০০৮ সালে নেপালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। সারা পৃথিবী জুড়ে যখন কমিউনিস্ট পার্টিগুলি হারের সম্মুখীন হচ্ছিল, তখন সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শাসন ক্ষমতা দখল করা বামপন্থীরা নতুন আশার সঞ্চার ঘটিয়েছিল। একথা মাথায় রাখতে হবে নেপালে আক্ষরিক অর্থেই গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি শাসন ব্যবস্থা কে ক্ষমতা থেকে সরানো সম্ভব হয়েছিল। ফলে নতুন তৈরি হওয়া সরকারের কাছ থেকে নেপালের মানুষের প্রত্যাশা ছিল গগণচুম্বী। কিন্তু গত কয়েক বছরে নেপালের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল অর্থাৎ নেপালি কংগ্রেস, সিপিএন (ইউএমএল) এবং মাওইস্ট সেন্টার রাষ্ট্র ক্ষমতাকে নিয়ে প্রায় মিউজিক্যাল চেয়ার খেলেছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনের সামগ্রিক কোনো উন্নতি হয়নি। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে সংক্ষেপে নেপালের রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস দেখে নেওয়া যাক। কারণ, বর্তমান আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বুঝতে এই আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম।
নেপালে রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস (২০০১–২০০৮)
২০০১ সালের জুন মাসে নেপালের রাজপ্রাসাদে ঘটে যায় ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। রাজা বিরেন্দ্র, রানী ঐশ্বর্য এবং উত্তরাধিকারী দীপেন্দ্র-সহ প্রায় পুরো রাজপরিবার নিহত হন। এই ঘটনার পর রাজা গ্যানেন্দ্র সিংহ সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তাঁর শাসন দ্রুত জনগণের অসন্তোষের কারণ হয়ে ওঠে। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্যানেন্দ্র সংসদ ভেঙে নির্বাহী ক্ষমতা নিজের হাতে নেন। জরুরি অবস্থা জারি হয়, সংবাদপত্র দমন করা হয়, রাজনৈতিক দলগুলো কার্যত নিষিদ্ধ হয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এটিকে প্রকাশ্যে স্বৈরাচারী পদক্ষেপ বলে আখ্যা দেয় (Nepal News)।
এই অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো এবং মাওবাদীরা ২০০৫ সালে দিল্লিতে ঐতিহাসিক “১২ দফা সমঝোতা” স্বাক্ষর করে। এর মূল লক্ষ্য ছিল রাজতন্ত্র উৎখাত এবং একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা। ২০০৬ সালের এপ্রিলে শুরু হয় জনআন্দোলন-২। টানা ১৯ দিন ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষ কার্ফু ভেঙে রাজপথে নেমে আসে। শ্রমিক, ছাত্র, নারী, গ্রামীণ কৃষক— সকলেই এই আন্দোলনে যোগ দেয়। চাপের মুখে গ্যানেন্দ্র সংসদ পুনর্বহাল করতে বাধ্য হন। এটিই ছিল রাজতন্ত্রের পতনের শুরু (Nepal News)। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে অন্তর্বর্তীকালীন সংসদ আনুষ্ঠানিকভাবে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করার প্রস্তাব পাস করে এবং নেপালকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণার ভিত্তি তৈরি করে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানায়:
“Lawmakers formally approved … to abolish the centuries-old monarchy and declare the country a republic” (Dawn)।
২০০৮ সালের ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় সংবিধান রচনা পরিষদের নির্বাচন। এতে মাওবাদীরা সর্বাধিক আসন লাভ করে। নির্বাচনের পর তারা ঘোষণা করে যে রাজতন্ত্র আর থাকবে না (The Guardian)। অবশেষে ২০০৮ সালের ২৮ মে সংবিধান রচনা পরিষদের প্রথম বৈঠকে ভোটাভুটির মাধ্যমে নেপালের রাজতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে। ৫৬০ জন প্রতিনিধি পক্ষে এবং মাত্র চারজন বিপক্ষে ভোট দেন। নেপালকে ঘোষণা করা হয় ফেডারেল ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক হিসেবে (France24, Jurist)। একই দিন নারায়ণহিটি প্রাসাদ থেকে রাজকীয় পতাকা নামিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়, পরে সেই প্রাসাদকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয় (OneIndia)।
২০০৮ পরবর্তী কমিউনিস্ট শাসন, বিতর্ক এবং বিক্ষোভের চোরা স্রোত
২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে নেপাল যখন ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হল, তখন অনেকেই আশা করেছিলেন যে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সরকার নেপালকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু পরবর্তীতে নেপালের কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন সরকার নানা অভিযোগ, অস্থিরতা এবং ভাঙনের সম্মুখীন হয়, যার ফলে জনগণের আশা অনেক ক্ষেত্রেই পূরণ হয়নি। প্রথম থেকেই কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর ভেতরে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। নেপালের মাওবাদী সশস্ত্র বিদ্রোহ থেকে মূলধারায় আসা দল ক্ষমতার আসনে বসে নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তারা সংসদ ও সরকারকে নিজেদের ক্ষমতা সুসংহত করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। মাওবাদী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপের অভিযোগ ওঠে। মাওবাদীরা সংবিধান প্রণয়নে দেরি করতে থাকে, বারবার ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে সংসদে সংঘাত তৈরি হয় এবং শেষ পর্যন্ত জনগণের মনে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।
অন্যদিকে, নেপালের আরেক শক্তিশালী ধারা ছিল ইউনিফাইড মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট বা ইউএমএল। মাওবাদীদের সঙ্গে তারা কখনও জোটে, আবার কখনও বিরোধেও ছিল। ২০১৮ সালে নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বড় ঘটনা ঘটে যখন ইউএমএল এবং মাওবাদী সেন্টার একত্র হয়ে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি নামে একটি বৃহৎ ঐক্য গঠন করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি ও প্রাক্তন মাওবাদী নেতা প্রচণ্ড যৌথ নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসেন। অনেকে মনে করেছিলেন এই ঐক্য দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা আনবে। কিন্তু দ্রুতই প্রকাশ পায় ভেতরের টানাপোড়েন।
ওলির ওপর অভিযোগ ওঠে যে তিনি একচ্ছত্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চান, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করছেন, বিচার বিভাগ ও রাষ্ট্রপতির পদকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ ওঠে যে তিনি সংসদকে পাশ কাটিয়ে নির্বাহী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এবং সমালোচকদের দমন করছেন।
২০২০ সালে রাজনৈতিক সংকট চরমে ওঠে যখন ওলি আকস্মিকভাবে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দেন। এই পদক্ষেপকে বিরোধীরা শুধু অসাংবিধানিক নয়, বরং সরাসরি গণতন্ত্রবিরোধী হিসেবে আখ্যা দেয়। সুপ্রিম কোর্ট শেষ পর্যন্ত সংসদ পুনর্বহাল করে। এই সময়ে রাজপথে ব্যাপক বিক্ষোভ হয় এবং সরকারের প্রতি আস্থা আরও কমতে থাকে। কমিউনিস্ট পার্টির ঐক্যও বেশিদিন টেকে না। ২০২১ সালে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টিকে আদালত বাতিল ঘোষণা করে, কারণ নিবন্ধন সংক্রান্ত ত্রুটি এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাত মীমাংসা করা যায়নি। ফলে মাওবাদী সেন্টার ও ইউএমএল আবার আলাদা হয়ে যায়। এই ভাঙন নেপালের বাম রাজনীতিকে দুর্বল করে দেয় এবং জনগণের চোখে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পায়। দলের ভাঙনের পাশাপাশি সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়েও সমালোচনা তীব্র হয়। দুর্নীতির নানা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসে। সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম, দলীয় নেতাদের আর্থিক সুবিধা প্রদান এবং জনগণের অর্থ অপচয় হয়েছে। সংবাদপত্র ও নাগরিক সমাজ বারবার লিখেছে যে কমিউনিস্ট নেতারা নিজেদের ক্ষমতার সুরক্ষায় রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছেন, সাধারণ মানুষের সমস্যার সমাধানে নয়। জনগণের আস্থা হারানোর অন্যতম কারণ ছিল সরকারের অদক্ষতা এবং মহামারীর সময় দুর্বল ব্যবস্থাপনা। কোভিড–১৯ এর সময় পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা না থাকা, দুর্বল টিকা সংগ্রহ নীতি, এবং ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি জনগণকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
এছাড়া বিরোধীদের কণ্ঠ দমনের অভিযোগও ওঠে। সমালোচনাকারী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা, নাগরিক সমাজের নেতাদের হুমকি, আন্দোলন দমনে পুলিশি দমননীতি— এসব নেপালের গণতান্ত্রিক চর্চাকে সীমিত করেছে। ২০১৯ সালে ঝलঝইয়া অনলাইন পোর্টালের সম্পাদক ক্ষেম থাপালিয়া এবং ইঝঝাল্কো’র সজন সৌদ-সহ একাধিক সাংবাদিককে বিদ্রোহী কমিউনিস্ট দলের সাথে যুক্ত থাকার অপরাধে গ্রেফতার করা, রেডিও নেপালের বোর্ড সদস্য দীপক পাঠক সামাজিক মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনার জন্য গ্রেপ্তার হন এবং ২০২৫ সালের মার্চে কাঠমান্ডুতে একটি রাজতন্ত্রপন্থী র্যালি চলাকালীন পুলিশ শক্তির ব্যবহার হয়— টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও জলকামান ব্যবহারে দুইজন নিহত হওয়া-সহ একাধিক গণতন্ত্র বিরোধী ঘটনা সামনে আসতে শুরু করে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো সরকারের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ করেছে যে তারা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের উপর বলপ্রয়োগ করছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও দলিত সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতা পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
নেপালের কমিউনিস্ট আন্দোলনের আরেক বড় দুর্বলতা ছিল ভেতরের গোষ্ঠীবাদ। কেপি ওলি, মাধব নেপাল— প্রত্যেকেই নিজেদের প্রভাব বাড়াতে দলকে ব্যবহার করেছেন। এর ফলে বারবার সরকার পরিবর্তন হয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত নেপালে প্রায় এক ডজনের বেশি সরকার পরিবর্তন হয়েছে, বেশিরভাগই বামপন্থী বা তাদের নেতৃত্বাধীন। কিন্তু এই অস্থিরতা জনগণের জন্য স্থিতিশীল উন্নয়ন বা গণতান্ত্রিক অগ্রগতি আনতে পারেনি। বরং সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে যে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব শুধু ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ব্যস্ত।
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছাড়াও নেপালের পররাষ্ট্রনীতি নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক, চিনের প্রভাব বৃদ্ধি, এবং আন্তর্জাতিক দাতাদের চাপ সামলাতে সরকার বারবার ব্যর্থ হয়েছে। সমালোচকরা বলেন, কমিউনিস্ট সরকার কখনও চিনের প্রভাবে, কখনও ভারতের চাপের কাছে নতিস্বীকার করেছে, যা নেপালের স্বাধীন সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতাকে সীমিত করেছে। এই কারণে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং রাজতন্ত্রপন্থীদের মধ্যে নতুন করে সমর্থন তৈরি হয়েছে।
গণতান্ত্রিক কাঠামোতে কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে অক্ষমতা। সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়েছিল, নতুন প্রদেশভিত্তিক কাঠামোতে কার্যকারিতা আনতে পারেনি, আর্থিক বৈষম্য কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার অভাব এবং ক্ষমতার জন্য লড়াই জনগণের হতাশা বাড়িয়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, নেপালের রাজনীতি এক ধরনের চক্রাকারে ঘুরছে— বামপন্থী দলগুলো ক্ষমতায় এসে দুর্নীতি ও দমননীতির কারণে ব্যর্থ হয়, আবার নতুন জোট তৈরি হয়, আবার একই ঘটনা পুনরাবৃত্তি হয়।
২০২২ কাঠমান্ডু মেয়র নির্বাচন এবং বিক্ষোভের চোরা স্রোত
২০২২ সালে কাঠমান্ডুর মেয়র নির্বাচনে স্বাধীন প্রার্থী বলেন্দ্র শাহর বিজয় নেপালের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। দীর্ঘ সময় ধরে রাজধানী-সহ দেশের রাজনীতিতে প্রধানত কমিউনিস্ট পার্টির শক্তিশালী দাপট ছিল। বিশেষ করে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙনের পরও তাদের প্রভাবশালী উপস্থিতি স্থানীয় নির্বাচনে বজায় থাকবে বলেই সাধারণভাবে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু শাহর জয় সেই ধারণাকে ভেঙে দেয় এবং এটিকে নেপালের কমিউনিস্ট নেতৃত্বের জন্য প্রথম বড় সংকেত হিসেবে দেখা হয়। বলেন্দ্র শাহ মূলত একজন র্যাপার ও স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলে যুক্ত ছিলেন না এবং প্রচলিত রাজনৈতিক প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। যখন তিনি কাঠমান্ডুর মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী হন, অনেকেই একে প্রতীকী চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করে জনগণ শুধু প্রতীকী বার্তা দিতে নয়, বরং বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করতেই তাঁকে বিজয়ী করেছে।
কমিউনিস্ট পার্টিগুলো এই নির্বাচনে কাঠমান্ডুর মতো একটি কেন্দ্রকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। তাদের প্রার্থীরা ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে পারেননি, কারণ দীর্ঘদিনের শাসন ও দুর্নীতির অভিযোগ, অভ্যন্তরীণ ভাঙন এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব জনগণকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। শাহ তাঁর নির্বাচনী প্রচারে এই হতাশা কাজে লাগান। তিনি পরিষ্কার শহর, উন্নত সেবা এবং জবাবদিহিমূলক প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি দেন, যা ভোটারদের আকৃষ্ট করে। শাহর জয় নেপালের রাজনীতিতে যেমন এক নতুন সম্ভাবনার সঞ্চার করে অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টি গুলির ব্যর্থতা সামনে নিয়ে আসে। ফলে স্পষ্টতই বলা বলেন্দ্র শাহের এই বিজয় শুধুমাত্র একজন স্বাধীন প্রার্থীর বিজয় নয়, বরং এটা ছিল প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তির প্রতি জনগণের আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ। বিশেষ করে বামপন্থী রাজনীতির প্রতি যে বিশ্বাস ২০০৮ সালের রাজতন্ত্র পতনের সময় জনগণ দেখিয়েছিল, সেটি এই নির্বাচনের মাধ্যমে ভাঙতে শুরু করে। কাঠমান্ডুর মতো কৌশলগত শহরে কমিউনিস্ট পার্টির হার ছিল তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতার প্রতীক।
২০২২ সালের পর নেপালের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠতে শুরু করে। কাঠমান্ডুর মেয়র নির্বাচনে বলেন্দ্র শাহর বিজয়ের মাধ্যমে জনগণের হতাশার প্রকাশ স্পষ্ট হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোতে কেন্দ্রীয় সরকার সেই বার্তাকে গ্রহণ করার বদলে পুরনো রাজনীতির পচা পাঁকেই ঘুরতে থাকে। প্রশাসনিক ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নেপালের শাসনব্যবস্থা ধীরে ধীরে গভীর সংকটে পড়ে।
২০২২–২৩ অর্থবছরে যুব বেকারত্ব
১৫–২৪-বয়সীদের মধ্যে ২২.৭ %, যা ১৯৯৫-৯৬ সালের ৭.৩ % থেকে ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে (CESLAM)। একই সময়ে মোট বেকারত্ব ১২.৬ %, যা ২০১৭-১৮ সালের ১১.৪ % থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে (CESLAM) । এর ফলে বেকার যুব সমাজের হতাশা এবং সরকারের বিতৃষ্ণা তৈরি হতে শুরু করে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য ক্রমাগত বাড়তে থাকে। শহর ও গ্রামীণ অঞ্চলের মধ্যে ফারাক বৃদ্ধি পায়।২০২২–২৩ অর্থবছরে নাগরিক জীবনযাপনের মূল্যসীমার নিচের অবস্থানে থাকা শহরাঞ্চলের দরিদ্রতার হার ১৮.৩৪ %, তুলনায় গ্রামীণ অঞ্চলে এই হার ২৪.৬৬ % (Asia News Network)। শহুরে অভিজাত শ্রেণি সিংহভাগ সম্পদ ও সুবিধা দখল করে রয়েছে, আর গ্রামীণ জনগণরা অবহেলিত। নেপালে কৃষিও সংকটে এবং উৎপাদনশীলতারও পতন ঘটেছে। অনেক তরুণ বিদেশে অভিবাসনের চেষ্টা করছে, কারণ দেশে কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। বিদেশে রেমিট্যান্স পাঠানো শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতিকে কিছুটা ভাসিয়ে রাখলেও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে তা ব্যর্থ হয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, নেপালের জনসংখ্যার ২০% দারিদ্রসীমার নিচে জীবন যাপন করছে (Reuters)। একই রিপোর্ট দেখায় যে, দেশের সবচেয়ে ধনী ১০% লোকের আয়, দেশের সবচেয়ে হতদরিদ্র ৪০ %–এর আয়ের তিনগুণেরও বেশি (Reuters)। অর্থাৎ ঊর্ধ্ববিত্ত ও নিম্নবিত্তের মধ্যে আয়ের ব্যবধান বিশাল।
২০২৫-এর আন্দোলন এবং বাস্তব অবস্থা
আজকের নেপালের সরকার বিরোধী গণআন্দোলন আকাশ থেকে পড়েনি। বরং গত ২০ বছর ধরে কমিউনিস্ট দলগুলির অপরিণত ও মূল্যহীন রাজনীতির ফলে এই আন্দোলন গড়ে উঠেছে। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে যতই আমরা আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের ভূত দেখিনা কেন, একথা বাস্তব যে নেপালে গণতান্ত্রিক পরিসর সংকুচিত হচ্ছিল। দীর্ঘদিন ধরে চরম দমনপীড়ন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ না করা, আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্যে দিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল তার পতন ছিল সময়ের অপেক্ষা। দক্ষিণপন্থীরা আজকে দাঁড়িয়ে ভারতের বিরুদ্ধে আমেরিকার ষড়যন্ত্র প্রমাণ করতে একাধিক গল্প বানাতেই পারে কিন্তু আজকের সময়ে ব্যাথিত করে বামপন্থীদের শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক সচেতনতা উপেক্ষা করা। একথা সত্যি গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে আমেরিকা মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক-সহ একাধিক দেশে সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ চালিয়েছে এবং বামপন্থীদের কর্তব্য আন্তর্জাতিকতাবাদকে সামনে সেখানের জনগণের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু তাই বলে সব ক্ষেত্রেই গণতন্ত্রের জন্য লড়াইকে সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত বলে দাগিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে বাস্তববর্জিত উন্নাসিকতা প্রকাশ পায়। খাদ্যের দাবি এবং গণতন্ত্রের দাবি একে ওপরের পরিপূরক নয়। বরং বামপন্থীদের ক্ষমতায় এসে বৈষম্য, বেকারত্ব দূর করার পাশাপাশি অন্যতম প্রধান কর্তব্য হয়ে ওঠে দেশের শাসন ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক করে তোলা যাতে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সবথেকে প্রান্তিক মানুষের স্বরটা শোনা যায়। একনায়কতন্ত্র এবং একটি আমলাতান্ত্রিক শ্রেণী তৈরির মাধ্যমে সমাজের ক্ষমতা পুজিভুত করার চেষ্টা করলে মানুষ বিদ্রোহ করবেই এবং সেই বিদ্রোহের সুফল গ্রহণ করবে সেই সময়ে আন্দোলনে থাকা সবথেকে সূঃসংঘবদ্ধ শক্তি। তা সে দক্ষিণপন্থী হোক বা বাম। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে যদি কমিউনিস্ট পার্টিগুলি সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বিপ্লব কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করে গণতান্ত্রিকতার নামে বুর্জোয়া ব্যবস্থার মধ্যে ঘুরপাক খেত তাহলে বিপ্লব মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। নেপাল তাঁর ব্যতিক্রম নয়।
যদিও নেপালের ক্ষেত্রে একটি ভাল বিষয় হল এই আন্দোলনে বিভিন্ন বামপন্থী শক্তি গুলি রাস্তায় আন্দোলনে আছেন এবং বেশ কিছু অংশে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ফলে যদি তাঁরা এই আন্দোলোনের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে রাখতে পারেন তাহলে দক্ষিনপন্থীদের বিজয় খুব সোজা হবে না। এছাড়াও নেপালি কংগ্রেস-সহ অন্যান্য দল গুলি আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি তৈরি প্রস্তাবকে মেনে নেয়নি। ফলে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা এই আন্দোলনকে কতটা এশিয়াতে নিজের দখল বজায় রাখতে সাহায্য রাখত তা সময় বলবে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে নেপাল- গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনের শ্রমিক-কৃষকদের দাবিদাওয়াকে অস্বীকার করে, সবাইকে সাম্রাজ্যবাদীদের হাতের পুতুল হিসেবে দেখানোর মধ্যে দিয়ে মানুষকে আসলে বাইরের শক্তির দ্বারা প্রভাবিত করতে শুরু করবে। ফলে একদিকে যেমন বামপন্থীদের শ্রমিকশ্রেনীর সচেতনতাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ঠিক তেমনই একইসাথে আন্তর্জাতিকতাবাদের দোহাই দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর কাছে তাঁদের নিজেদের সমস্ত দাবিকে ধূলিসাৎ করে শোষণকে মেনে নেওয়ার জন্য বায়না করা ঠিক না।
নেপালের অবস্থা প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তন হচ্ছে। প্রথম দিন এই আন্দোলন সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ বিরোধী আন্দোলন থাকলেও দ্বিতীয় দিনে ভয়ঙ্কর অগ্নি সংযোগ থেকে সরকারকে উচ্ছেদ করার বর্তমান আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করে। বর্তমানে একথা স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছেনা এর পেছনে কোনো রাজনৈতিক দলের হাত আছে কিনা। তবে এই প্রবন্ধ লেখার সময় অবধি পাওয়া খবর অনুযায়ী, বলেন্দ্র শাহ নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের উদ্দেশ্য সেনা প্রধানের সঙ্গে মিটিং করেছেন। সাম্প্রতিক ইতিহাসে ক্ষমতায় আসার পর ২০২২ শালের ডিসেম্বরে মেয়র শাহ হকার উচ্ছেদ সম্পর্কে ভীষণ রকম শ্রমিক বিরোধী মন্তব্য করেন। ফলে তিনি ক্ষমতায় বসলে নেপাল কতটা বামপন্থী অবস্থায় হাঁটবে তা নিয়ে সন্দেহ থাকে। এছাড়াও এই আন্দোলন প্রাথমিক ভাবে শহুরে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে যদিও গ্রামাঞ্চলে মানুষের মধ্যে মাওবাদী-সহ অন্যান্য কমিউনিস্ট পার্টি গুলির যথেষ্ট প্রভাব আছে। ফলে সাময়িকভাবে বলেন্দ্র শাহ প্রধানমন্ত্রী হলেও সমস্ত টানাপোড়নের সমাধান হবে তা বলা মুশকিল। পরবর্তী দিনগুলি নেপালের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কোন ধরনের সামগ্রিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে পরবর্তী কিছুদিনের ঘটনা প্রবাহ দেখা জরুরি বলে মনে হয়।
(এই লেখাটি inscript.me তে প্রকাশিত হয়েছে। Alternative Viewpoint এ পুনঃপ্রকাশ করা হলো।