
ইজরায়েলি অবরোধে যখন প্যালেস্তাইনে রক্তক্ষরণ অব্যাহত, ঠিক তখনই আরব রাজতন্ত্রগুলি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বরণ করতে এবং তাঁর সঙ্গে বহু মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করতে ব্যস্ত। অবশ্য স্বৈরাচারী ধনকুবেরদের জোট প্যালেস্তিনিয় জনগণের দুর্দশা নিয়ে নিজেদের শান্তি বিঘ্ন করতে যাবেই বা কেন? মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প গত ১৩-১৬ মে ধুমধাম করে সৌদি আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহী সফর সারলেন। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিয়ে এটিই তাঁর প্রথম সরকারি বিদেশ সফর।
শুল্ক নিয়ে নানাবিধ হম্বিতম্বি এবং বাণিজ্য যুদ্ধ ঘোষণা নিয়ে বিশ্ব বাজার কিছুদিন টালমাটাল থাকলেও শেষপর্যন্ত মার্কিন অধিরাজকে আপাতত রণে ভঙ্গ দিতে হয়েছে। কারণ বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশ, মার্কিন জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ, এমনকি বড় বড় পুঁজিপতিরাও তাঁর কাজকর্মের সমালোচনায় মুখর ছিলেন। অবশ্য ভারতের শাসকগোষ্ঠীর মত তাঁর অনুগত চিয়ারলিডাররা ট্রাম্পের এই একতরফা পদক্ষেপ নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিল, এখনো আছে।
ক্ষুব্ধ আরবভূমি
কিন্তু আরবের জনগণ ট্রাম্পকে পছন্দ করেন না। তাঁরা মার্কিন সহায়তায় ইজরায়েলের গাজায় সংঘটিত গণহত্যাকে মেনে নেন না। এই চলমান গণহত্যার বয়স এখন ১৯ মাস। এই সময়ের মধ্যে ইজরায়েল কমপক্ষে ৬৪,০০০ প্যালেস্তিনিয়কে খুন করেছে, সমস্ত হাসপাতাল ও স্কুল ধ্বংস করেছে এবং অবশিষ্ট মানুষের কাছে মানবিক সাহায্য (খাদ্য, জল, ওষুধ ও জ্বালানি) পৌঁছনোর রাস্তা আটকে দিয়েছে। ইরান আক্রমণের হুমকি, ইয়েমেনে নৃশংস বোমা হামলা, সিরিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি লেবানন ও সিরিয়ায় ইজরায়েলি আগ্রাসনকে সমর্থন করার জন্য আরব জনতা ট্রাম্পকে প্রত্যাখ্যান করেন।
তাই এই সফরকে নিরুপদ্রব করে তুলতে এবং এই অঞ্চলে দীর্ঘকালীন মার্কিন প্রভাব বজায় রাখতে ট্রাম্প তাঁর আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী ভাবমূর্তি পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন। তিনি কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থানকালে হামাসের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করেন, যা গাজায় মানবিক সহায়তার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে এক মার্কিনজাত ইজরায়েলি বন্দির মুক্তি নিশ্চিত করে। গত ২ মার্চ থেকে ইজরায়েলের পূর্ণ অবরোধের ফলে গাজার পাঁচ লক্ষের উপর বাসিন্দা অনাহারে রয়েছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানে নিয়ন্ত্রিত পারমাণবিক কর্মসূচি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবং একইসঙ্গে পশ্চিম এশিয়ায় ইরানের মিত্রদের – লেবাননের হিজবুল্লা, ইয়েমেনের হুথি এবং ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া – পাশে পাওয়ার জন্য ওমান ও ইতালিতে ইরানের সঙ্গে চার দফা আলোচনা করে। এই সমর্থনের বিনিময়ে মার্কিনিরা ইরানের বিরুদ্ধে সার্বিক নিষেধাজ্ঞা কিঞ্চিৎ শিথিল করবে এবং সরাসরি বা ইজরায়েলের মাধ্যমে কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেবে না। এই নিয়ে আলোচনা ও দুপক্ষের দর কষাকষি চলছে।
ওমান সরকারের মাধ্যমে ট্রাম্প ইয়েমেনি হুথিদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেছিলেন। ইয়েমেনের বিরুদ্ধে অকার্যকর সামরিক আগ্রাসন স্থগিত করেছেন। এই সামরিক অভিযান হুথিদের পরাজিত করা তো দূরের কথা, তাদের সামান্য দুর্বলও করতে পারেনি। ইতিমধ্যে হুথিরা সাতটি মার্কিন ড্রোন গুলি করে নামিয়েছে, যার প্রতিটির মূল্য ৩০ মিলিয়ন ডলার। এছাড়াও লোহিত সাগরে দুটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। একেকটির মূল্য ছিল ছ কোটি ৭০ লক্ষ মার্কিন ডলার। এই ৫০ দিনের আগ্রাসন চালাতে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ হয়েছে। ব্যর্থ হওয়া ছাড়াও এই মার্কিন আগ্রাসন – সৌদি নেতাদের মতে – ট্রাম্পের আরব সফরকেও বিপন্ন করতে পারত। হুথিরা এই অঞ্চলের মার্কিন লক্ষ্যবস্তু, এমনকি সৌদি রাজধানী রিয়াধেও, আক্রমণ করতে পারত। হুথিদের সঙ্গে চুক্তি মার্কিন লক্ষ্যবস্তুগুলির বিরুদ্ধে আক্রমণের বিপদ দূর করে। অবশ্য হুথিরা এই মুহূর্তে ইজরায়েলকে কোনোরকম ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়। ইজরায়েলি লক্ষ্যবস্তুগুলির উপর তাদের আক্রমণ অব্যাহত আছে।
বহু মিলিয়ন ডলারের চুক্তি
এই সফর কতটা সরকারি প্রয়োজনে এবং কতটা ব্যক্তিগত ব্যবসার স্বার্থে, তা নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি সমালোচনার মুখে পড়েছেন। তিনি সোশাল মিডিয়ায় ঘোষণা করেছিলেন যে কাতার সরকারের কাছ থেকে একটি বোয়িং ৭৪৭-৮ বিমান ‘উপহার’ হিসাবে পাবেন, যা নতুন এয়ার ফোর্স ওয়ান হয়ে উঠবে। এই বিমানটিকে তাঁর মেয়াদ শেষে তিনি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য রেখে দেবেন। সৌদি আরবে একটি রিয়েল এস্টেট সংস্থার সঙ্গে ট্রাম্প পরিবারের ছটি চুক্তি বাকি রয়েছে। সেই সংস্থার বেশিরভাগ শেয়ারের মালিক সৌদি আরবের রাজা। ভুলে গেলে চলবে না, রাষ্ট্রপতি হিসাবে তাঁর প্রথম ইনিংসে (২০১৭-২০২০) ট্রাম্পের ব্যবসাপাতিও ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। প্রথম তিন বছরে প্রতি বছর তিনি আনুমানিক ৬৫ কোটি মার্কিন ডলার আয় করেন। সংখ্যাটি আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারত, বাদ সাধে কোভিড। এই মহামারীর ফলে অর্থনীতি সঙ্কুচিত হওয়ার জন্য ২০২০ সালে তিনি মাত্র ৪৫ কোটি মার্কিন ডলার উপার্জন করতে সক্ষম হন।
রিয়াধে ট্রাম্প এবং সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি ঐতিহাসিক অর্থনৈতিক ও সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির মূল বিষয়গুলি (প্রতিশ্রুতি) হল – সৌদিকে ১৪২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রয়, মার্কিন সংস্থা গুগল ও ওরাকলের যৌথ প্রকল্পে ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ এবং সৌদি কোম্পানি ডেটাভোল্টের মার্কিন ডেটা সেন্টারগুলিতে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ। তাছাড়া ৪.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যে বোয়িং বিমান বিক্রি এবং মিশিগানে ৫.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার শিল্পে বিনিয়োগ।
সৌদির প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্র সফরের সূচনাকালে ট্রাম্পকে একটি ল্যাভেন্ডার কার্পেট পেতে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাগত জানায়। ২০২১ সাল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাষ্ট্রীয় অতিথিদের স্বাগত জানাতে সৌদি আরব লালের বদলে ল্যাভেন্ডার কার্পেট ব্যবহার করে থাকে। এই রংটি সৌদি রাজবংশের আভিজাত্যের প্রতীক। এরপর ট্রাম্পের সফর বিভিন্ন প্রাসাদ এবং বিলাসিতার মধ্যে কাটে। অন্যদিকে রিয়াধ থেকে ২,০০০ কিলোমিটারের মধ্যে একটি অঞ্চল ধ্বংস, আতঙ্ক এবং দুর্দশায় জর্জরিত। মার্কিন মদতে ইজরায়েল সেখানে রাষ্ট্রীয় গণহত্যা চালাচ্ছে। লেবানন, সিরিয়া এবং ইয়েমেনের সাধারণ মানুষও একই রকম জায়নবাদী আক্রমণের শিকার। ইরানও ইজরায়েলের আক্রমণের লক্ষ্য, যদিও সেখানকার মোল্লাতন্ত্রের পারমাণবিক কর্মসূচি বাতিল, বা অন্তত সীমিত করার চেষ্টায় ট্রাম্প শিবির তাদের সঙ্গে ওমানে আলোচনা শুরু করেছে।
একদিকে যখন ট্রাম্প ও আরব বুর্জোয়ারা ব্যবসায় মত্ত, অন্যদিকে তখন গাজার ধ্বংসলীলা অব্যাহত। মার্কিন রাষ্ট্রপতির আরব সফরের সপ্তাহে গাজা উপত্যকায় ইজরায়েলি বোমাবর্ষণ তীব্রতর হয়। ১৫ মে (নাকবা দিবসের বার্ষিকীতে) ১০০ জনেরও বেশি নিহত হন। মার্কিন মদত ছাড়া ইজরায়েলের পক্ষে দিনের পর দিন এই ধরনের আক্রমণ জারি রাখা সম্ভব নয়। অবশ্য ট্রাম্পের ধূর্ত সফরসঙ্গী ধনকুবের ইলন মাস্ক এইসব ব্যাপারে কোন রাখঢাক করেন না। তিনি সরাসরি এই গণহত্যার পক্ষে। কিন্তু আরব রাজবংশগুলির এই গণহত্যার মদতদাতাদের এহেন অভ্যর্থনা শুধুমাত্র প্যালেস্তিনিয় জনগণের উপর আরেকটি নিষ্ঠুর আঘাত নয়, আরব ভূমির সাধারণ মানুষেরও তীব্র অপমান।
সৌদি আরবে ৬০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতির কথা আগেই আলোচিত হয়েছে। কাতারে আমির শেখ তমিম বিন হামাদ আল-থানি ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যে ২০০টি বিমান কেনার জন্য হোয়াইট হাউসের বর্তমান মালিকের প্রধানের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। ট্রাম্প বলেছেন ‘এটি বোয়িংয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিমানের অর্ডার।’ এছাড়াও দোহার আমির আল-উদেঈদ সেনা ঘাঁটি সংস্কারের জন্য ৩৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেখানে ৮,০০০ মার্কিন সেনা মোতায়েন করা আছে। সেই প্রকল্প থেকে ফায়দা তুলবে সেই সমস্ত মার্কিন প্রতিরক্ষা ঠিকাদার সংস্থা, যারা ইজরায়েলকে অস্ত্র বিক্রি করে মুনাফা করে। কূটনৈতিক চাল হিসাবে কাতারের আমির তাঁর অতিথিকে একটি বোয়িং ৭৪৭-৮ বিমান উপহার দেওয়ার (ঘুষ) প্রস্তাব দেন। এতে নানা রাজনৈতিক ও নৈতিক সমস্যা থাকলেও, মার্কিন রাষ্ট্রপতির পদে আসীন ধনকুবের ট্রাম্প এই উৎকোচ গ্রহণ করতে এককথায় রাজি হয়ে যান। শেষমেশ আমিরশাহীতে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কেন্দ্র নির্মাণ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাইড্রোকার্বন শিল্পে আমিরশাহীর বিনিয়োগের ঘোষণার মাধ্যমে ট্রাম্পের সফর শেষ হয়।
আহমেদ আল শারার সঙ্গে বৈঠক
মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিয়াধে সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি এবং হায়াত তাহ্রির আল-শামের প্রধান আহমেদ আল শারার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, যা কয়েকমাস আগেও অকল্পনীয় ছিল। এই অসাধারণ সাক্ষাৎ সংক্ষিপ্ত হলেও তাৎপর্যপূর্ণ। রিয়াধে আল কায়দার সঙ্গে যুক্ত এই প্রাক্তন সিরীয় বিদ্রোহীর সঙ্গে ৩৭ মিনিটের বৈঠকের পর ট্রাম্প বলেন ‘আমি মনে করি ওর মধ্যে সম্ভাবনা আছে।’ মজার কথা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রাক্তন ‘সন্ত্রাসবাদী’-র মাথার মূল্য ধার্য করেছিল ১০ মিলিয়ন ডলার, যা সবে ডিসেম্বরে প্রত্যাহার করা হয়েছে। হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতি অনুসারে, ট্রাম্প সিরিয়ার নেতাকে ইজরায়েলের সঙ্গে আব্রাহাম চুক্তি স্বাক্ষর করতে, বিদেশি ও প্যালেস্তিনিয় সন্ত্রাসবাদীদের বহিষ্কার করতে, পুনরুজ্জীবিত ইসলামিক স্টেটের মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে এবং কিছু রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিতে অনুরোধ করেন।
সবই সিরিয়ার উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার শর্ত। ট্রাম্প অবশ্য তাঁর সফরের ঠিক আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে সিরিয়ার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়ে তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন। এই বৈঠকের ফলাফল আঞ্চলিক ভারসাম্যের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যায় সৌদির যুবরাজ বিন সালমান এবং টেলিফোনের মাধ্যমে তুর্কি রাষ্ট্রপতি রচপ তাইয়িপ এরদোগানের উপস্থিতি দেখে। তুরস্ক সিরিয়ার এই ইসলামি মৌলবাদী শাসকের কট্টর সমর্থক।
এই প্রাক্তন যোদ্ধা অবশ্য মার্কিন অনুগ্রহ পেতে আগ্রহী। তিনি সিরিয়ার তেল ও গ্যাস বন্ধক রাখার পাশাপাশি দামাস্কাসে একটি ট্রাম্প টাওয়ার (শপিং সেন্টার) নির্মাণের সম্ভাব্য প্রস্তাব নিয়ে ট্রাম্পকে একটি চুক্তির প্রস্তাব দেন। ধরে নেওয়া যায়, ইউক্রেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে ধরনের নয়া-ঔপনিবেশিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি তা দেখে উদ্বুদ্ধ। এছাড়াও তিনি ১৯৭৪ সালে স্বৈরাচারী শাসক হাফেজ আল আসাদ আর ইজরায়েলের মধ্যে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তি পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং নির্লজ্জের মত সিরিয়ায় বসবাস করা প্যালেস্তিনিয় ইসলামিক জিহাদের দুই সদস্যকেও গ্রেফতার করেছেন।
ট্রাম্প বনাম নেতানিয়াহু?
ইজরায়েলকে এড়িয়ে ট্রাম্পের এই মধ্যপ্রাচ্য সফর হোয়াইট হাউস ও তেল আভিভের সম্পর্কের অবনতি নিয়ে নানা গুজবের জন্ম দিয়েছে। এখন পর্যন্ত গাজার গণহত্যাকে কট্টর সমর্থন করা ছাড়া ট্রাম্প গাজা নিয়ে নানা বিষয়ে নানারকম পালটি খেয়েছেন। রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করার আগে তিনি বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, এই ধরনের ঝামেলা মাথায় নিয়ে যেন তাঁকে গদিতে বসতে না হয়। কয়েক সপ্তাহ পরে তিনি নিজেই আবার হামাসের হাতে বন্দি ব্যক্তিদের মুক্তির জন্য চূড়ান্ত সাবধানবাণী ঘোষণা করে জানুয়ারির যুদ্ধবিরতিকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, গাজার বাসিন্দাদের সম্পূর্ণ উৎখাত করে সেখানে বিলাসবহুল রিসর্ট নির্মাণের কুখ্যাত প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।আবার এই আরব সফরের ঠিক আগেই ট্রাম্প হামাসের সঙ্গে একটি সরাসরি আলোচনার রাস্তা খোলেন। এর ফলে তাঁর মধ্যপ্রাচ্য সফরের প্রাক্কালে শেষ আমেরিকান বন্দি, ইজরায়েলি সৈনিক এডান আলেকজান্ডারের মুক্তি সম্ভব হয়।
নেতানিয়াহুর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির মূল কারণ তিনটি। প্রথমত, হোয়াইট হাউস ও ইরানের মধ্যে আলোচনা তেল আভিভ মানতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, মে মাসের গোড়ার দিকে ইজরায়েলকে বাদ দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইয়েমেনি হুথিদের মধ্যে চুক্তি। লোহিত সাগরে মার্কিন বাণিজ্যতরীগুলির উপর মিলিশিয়া আক্রমণ বন্ধ করার বিনিময়ে হোয়াইট হাউস ইয়েমেনে বোমাবর্ষণ বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। হুথিরা প্যালেস্তিনিয়দের ঘনিষ্ঠ সমর্থক। তৃতীয়ত, সিরিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞার সমাপ্তি।
মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ এবং ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মার্কিন-ইরান সমঝোতার প্রধান খেলোয়াড়। ওয়াশিংটন তার পুরনো দাবিতে অটল রয়েছে – পারমাণবিক কর্মকাণ্ডের অবসান এবং হিজবুল্লাকে সমর্থন বন্ধ করা। এসব আসলে তেহরানের আঞ্চলিক প্রভাব খর্ব করার প্রচেষ্টা। আর্থিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইরানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাই হোক না কেন ‘শান্তি স্থাপক’ ট্রাম্প সতর্ক করেছেন যে আলোচনা ব্যর্থ হলে তিনি ইরানের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি লক্ষ্য করে সামরিক আক্রমণ চালাতে পারেন।
ইয়েমেনের ক্ষেত্রে হোয়াইট হাউস হুথিদের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে পেরেছে বলে মনে হলেও হুথিরা ইজরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে। আবার তেল আভিভও ইয়েমেনের লক্ষ্যবস্তুগুলিতে নিয়মিত আক্রমণ করে যাচ্ছে।
সিরিয়ার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিরোধিতা নেতানিয়াহুকে করতেই হবে। তেল আভিভ ২০২৪ সালে বাশার আল আসাদের পতনের ফলে তৈরি হওয়া অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে দক্ষিণ সিরিয়ায় ১৯৬৭ সাল থেকে দখল করে রাখা গোলান হাইটসে তার সামরিক উপস্থিতি সম্প্রসারিত করে। তারপর থেকে সংখ্যালঘু দ্রুজ সম্প্রদায়ের মানুষকে রক্ষা করার অজুহাতে সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি ভবনের আশেপাশে প্রায় ৭৫০টি বিমান হামলা চালায়। অবশ্য গণমাধ্যমের মতে, তেল আভিভ এবং সিরিয়ার নতুন সরকারের মধ্যে তলে তলে আলোচনা চলছে। কিন্তু জায়নবাদী সম্প্রসারণবাদের পক্ষে তাদের বাদ দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়ার সঙ্গে রফা করা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
MAGA-র কাণ্ডারী ট্রাম্প মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ যে কোনো মূল্যে বাস্তবায়িত করতে বদ্ধপরিকর। নেতানিয়াহু আর ট্রাম্পের মধ্যে অপ্রত্যাশিত সাময়িক উত্তেজনার কারণ এইটুকুই। মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করতে যদি তাঁর চিরাচরিত মিত্রদের অল্পবিস্তর ল্যাং মারতে হয়, ট্রাম্পের তাতে অসুবিধা নেই। মনে রাখা ভাল, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির মরীচিকা দেখানো এই ধনকুবের তাঁর সফরের মাঝেই আবার গাজার মানুষকে উৎখাত করার কথা বলেছেন।
গণহত্যা আর নয়
গাজার উপর যেনতেনপ্রকারেণ একটি সমঝোতা চাপিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আরব বুর্জোয়া গোষ্ঠী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুসম্পর্ক স্থাপনের নাটক করছে। এই সমঝোতা গাজার অভাগা মানুষগুলির জন্য আশার আলো জ্বালাতে পারবে না। প্যালেস্তিনিয় জনগণের অবর্ণনীয় পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মিশর এই ছিটমহলের পুনর্গঠনের জন্য প্রস্তাবের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ক্ষমতা থেকে হামাসকে অপসারিত করে একটি টেকনোক্র্যাটিক সরকার গঠনের শর্তে ধ্বংসপ্রাপ্ত এই ছিটমহলের পুনর্গঠন করা হবে। অবশ্য ট্রাম্পের উৎখাতের পরিকল্পনা এবং নেতানিয়াহুর প্যালেস্তাইনের অবলুপ্তির নকশার তুলনায় মিশরের এই বিকল্প কম বিপজ্জনক। বলা বাহুল্য, প্যালেস্তিনিয় কর্তৃপক্ষ মিশরীয় অবস্থানকে সমর্থন করে।
আরব বুর্জোয়াদের এই দৃষ্টিভঙ্গি এবং জায়নবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে সকলের নিঃশর্তভাবে প্যালেস্তিনিয় জনগণের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। গণহত্যা বন্ধ হোক। গাজা, লেবানন এবং সিরিয়া থেকে অবিলম্বে ইজরায়েলি সৈন্যদের অপসারণ দরকার। ইয়েমেনে হামলা বন্ধ হোক। পশ্চিম এশিয়া সাম্রাজ্যবাদ বিদেয় হোক। প্যালেস্তিনিয় এবং ওই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মানুষকে মানুষের মত বাঁচতে দেওয়া হোক।
(এই লেখাটি পূর্বে Nagorik.net পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।